শবে কদর প্রাপ্তি নিশ্চিতের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা রমজান মাসের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতগুলোয় লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করো’ (বোখারি-মুসলিম) । আজ রমজান মাসের শেষ দশ দিনের চতুর্থ বেজোড় রাত। হতে পারে আজ পবিত্র কদরের রাত। আল্লাহই ভালো জানেন। এবং এই কদরের রাতের মধ্যে রয়েছে এক সুপ্ত সফলতা, যার মধ্যে লুকায়িত আছে হাজার মাসের বেশি ইবাদতময় সফলতা।
এ রাতের অন্ধকার আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণ ঘটায়। আশা আর নির্ভরতায় হৃদয়ে দৃঢ়তা এনে দেয়। শক্তি সঞ্চার করে উচ্ছলতা আর চঞ্চলতায়। প্রাণের জাগরণ ঘটায়। পীড়িতের আরোগ্য, সর্বহারার সুদৃঢ় আশ্রয় , যন্ত্রণাকাতর হৃদয়ের পরম প্রাপ্তি, চরম তৃপ্তি হয় এ রাতে ইবাদতের মাধ্যমে। এ রাতে একটি মহান কিতাব একজন মহান ফেরেশতার মাধ্যমে একজন মহান রাসুলের ওপর একটি মহান উম্মতের জীবনবিধান হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিল। তাই এর নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল কদর বা মহিমান্বিত রাত।
এ রাতে মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল করা হয়েছিল। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম কোরআনকে একবারে প্রথম আসমানে অবস্থিত বাইতুল ইজ্জাতে নাজিল করেছেন। অতঃপর প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ২৩ বছরের নবুওয়াতি জীবনে সম্পূর্ণ কোরআন নাজিল করেছেন।’ (তাফসিরে ইবনে কাছির, খণ্ড: ৮, পৃষ্ঠা: ৪২৫)
আর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ওপর সর্বপ্রথম কোরআন নাজিল হয় ৬১০ খ্রিস্টাব্দে কদরের রাতে সূরা আলা-ক্ব এর প্রথম পাঁচ আয়াতের মাধ্যমে। সূরা আল-কাদরের প্রথম আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘নিশ্চয়ই আমি কদরের সন্মানিত রাতে কুরআন অবতীর্ণ করেছি।’ কুরআনিক মর্যাদার কারণে যেমন কদর মহিমাপূর্ণ, তেমনি কদরের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কোরআনও মহিমাপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
সেই কুরআনুল কারীমের সূরা ইয়াসিনের দ্বিতীয় আয়াত ‘বিজ্ঞানময় কুরআনের শপথ বা শপথ জ্ঞানগর্ভ কুরআনের’ উদ্বৃত করে বিশ্বাস রেখে বলতে চাই বর্তমান আধুনিক বিশ্বের সকল বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের উত্তরসমূহ এবং আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জন্য সমস্ত তত্ত্ব, উপাত্ত, প্রক্রিয়া ও প্রয়োজনীয় উপকরণ; বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার কারণ, বৈশিষ্ট্যসমূহের সম্পর্কে সম্যক ধারনা মহা বিজ্ঞানময় ধর্মগ্রন্থে প্রায় ১৪’শ বছর আগেই সন্নিবেশিত, লুক্কায়িত বা প্রকাশিত অবস্থায় আছে। ইতিমধ্যে অনেক বিজ্ঞানী নিশ্চিত করেছেন যে, পবিত্র কোরআনে আকাশের নক্ষত্রমণ্ডল, উপজাতীয় কণার প্রকৃতি এবং মানব ভ্রূণের বিকাশের বিষয়ে —অধুনা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের অনুরুপ — বর্ণনা উল্লেখ রয়েছে।
এই পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বিশ্ব-জগতের চারদিকে বিস্তৃত এবং নিজের মানবিক সত্তার মধ্যেই বিদ্যমান সুস্পষ্ট নিদর্শন সমূহের সত্যতার সাক্ষ্য দিয়ে চলছে। সরল বিশ্বাসীদের কাছে ধর্মীয় ঘটনা, নীতি, বিধিবিধান বৈধ করার জন্য বিজ্ঞানের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়না। বরং বিজ্ঞানচর্চা নানাভাবে এ বিজ্ঞানময় পবিত্র ধর্মগ্রন্থের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হতে পারে।
বিজ্ঞানের আধুনিক কালের গবেষণাগুলোর বিষয়ে প্রজ্ঞায় পূর্ণ আসমানী এই কিতাবে অনেক পূর্বেই ইঙ্গিত রয়েছে। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং আবিষ্কারের সমস্ত উত্তর উপাদান এতে নিহিত আছে। আমরা আরও গণিত, আরও পদার্থবিজ্ঞান এবং আরও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তা বের করে নিজেরা উপকৃত হতে পারি।
অন্ততঃ একটি উদাহরন দেয়া আবশ্যক বলে মনে করি। বিশ শতকে আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের জেনারেল থিউরি অব রিলেটিভিটি বিপ্লবী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল অবিশ্বাসীদের ধারনায় আমাদের নবীজির মিরাজে গমনের সত্যতার বিষয়ে। গাণিতিকভাবে ও পরীক্ষাগারে প্রমানিত হয়েছে আলোর গতি বা তার চেয়ে বেশীতে কয়েক মিনিটের মধ্যেই অতিক্রম করা সম্ভব হাজার হাজার বছরের অতিক্রম্য দূরত্ব বা পথ । চিরকালই ধর্মের বিষয়গুলো রহস্যময়। আছে নীরব। আমাদের রুদ্ধ ওষ্ঠাধর। আমাদের শুধু গভীর ধ্যান ও গবেষনার মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে। সরল বিশ্বাসে মিলবে এসবের উত্তর।
নব নব উদ্ভাবনের এই যুগে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। ‘যারা বলে আমি কখনোই ভুল করি নি, তারা জীবনে কিছুই করেনি। আমরা অহংকারের মাধ্যমে নিজের অজ্ঞতাকে লুকিয়ে রাখি বা ভুলকে অস্বীকার করি। আমরা সাধারন মানুষরা ভুল করবো এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মাধ্যমে তাঁহার নৈকট্য লাভ করা যায়। আজ অন্ততঃ ক্বদরের এই রাতে মেনে নেই চলার পথের প্রতি পদক্ষেপে আমরা করে যাচ্ছি অজস্র ভুল আর গুনাহের কর্ম। নিজের দাম্ভিকতা আর অহংকারকে শূণ্যের কোটায় নামিয়ে এনে মহান আল্লাহর কাছে নিজের কৃত ভুল আর গুনাহর জন্য ক্ষমা চাই।
বিভিন্ন মহাজ্ঞানী- মহাজনের ঐক্য মতে আল্লাহ তা’আলার কাছে ক্ষমা ভিক্ষার জন্যে এই দোয়াটি পড়া উত্তম। কারন এই দোয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা (রাঃ) কে শিক্ষা দিয়েছিলেন। ইমাম তিরমিযি মা আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনার কি অভিমত, যদি আমি জানতে পারি যে, কোন রাতটি লাইলাতুল ক্বদর তখন আমি কি বলব? তিনি বললেন: তুমি বলবে: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি (অর্থ- হে আল্লাহ্! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করাটা আপনি পছন্দ করেন। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দিন।” (তিরমিযী: ৩৫১৩) । তাই বারে বারে পড়ি ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি’ ইয়া গাফুরু, ইয়া গাফুরু!!
নিজেদের গুনাহ মাফের জন্য ক্ষমা চাইবার সাথে সাথে মহান আল্লাহতা’লার কাছে এই প্রার্থনাও করি যেন তিনি তাঁর অসীম করুনায় করোনা মহামারী সহ অতি আসন্ন, অনাগত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুঃখ, কষ্ট, হতাশা থেকে আমাদেরকে মুক্তি দেন। আত্মশুদ্ধির তাওফীক দান করেন। হেদায়েত নসীব করেন। আমিন।
ফরিদ আহমদ