সরকারি চাকুরে মমিন সাহেব। দারুন বৃক্ষপ্রেমী মানুষ। অফিসের কাজে হর-হামেশাই তাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়। ট্যুরে গিয়ে তার কোনো এক্সট্রা ইনকাম হয় না। মিথ্যা ভাউচার বানাতে পারেন না তিনি। সেজন্য অবশ্য তার হাপিত্যেশ নেই। স্থানীয় বিভিন্ন প্রজাতির গাছ সংগ্রহ করে এনে নিজের বাড়িতে লাগাতে পেরেই খুব আনন্দিত তিনি। তার বাড়িটাকে ছোট খাট একটা অরণ্য বললে অত্যুক্তি হবে না। ছেলে পলিনকে অবসরে বাগানের বাড়ন্ত নানান ঔষধি গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন।
মমিন সাহেব মজা করে প্রায়শই স্ত্রীকে বলেন, ‘শারমিন, তুমি দেখো, আমার সবুজ মৃত্যু হবে।’
শারমিন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। জেলার বিসিক শিল্পনগরীর একটা ফ্যাক্টরিতে মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে একসময় কাজ করতেন। পলিনের জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দেন।
রাশভারী শারমিন প্রথম প্রথম স্বামীর মুখে একথা শুনে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। বলতেন, ‘দেখো, পলিনের বাবা, আমি লাল সবুজ শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাম শুনেছি। তুমি কি সব সবুজ মৃত্যু-টিত্যুর কথা বল। এসব শুনতে আমার একদম ভালো লাগে না।’
তখন রহস্যময় হাসি দিয়ে মমিন সাহেব স্ত্রীকে বলতেন, ‘বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদোনা শারমিন। আসলে আমি কোথাও পড়েছিলাম যে, নির্বিলাস সাদাসিধে জীবন যাপন করলে মানুষের সবুজ মৃত্যু হয়। ধর, এটা অনেকটা তোমার কল-কারখানার সবুজ রঙের ছাড়পত্রের মতন।’
বাবা-মায়ের বেশি বয়সের সন্তান পলিন। খুব পড়ুয়া ছেলে। সন্ধ্যায় হেমচন্দ্রের ‘জীবনসঙ্গীত’ কবিতা আবৃত্তি করছিল লকডাউনে ঘরবন্দী পলিন। ‘ব’ল না কাতর স্বরে, বৃথা জন্ম এ সংসারে, এ জীবন নিশার স্বপন; দারা পুত্র পরিবার তুমি কার, কে তোমার, ব’লে জীব ক’রো না ক্রন্দন।’ মমিন সাহেব চুপ করে এতক্ষন ছেলের আবৃত্তি শুনছিলেন।
নীরবতা ভেঙে বললেন, ‘অন্যদের কথা জানিনা। তবে মনে রেখ, বাবা পলিন, মায়ের ভালোবাসা সত্যিই নিঃস্বার্থ।’ একথা বলে তিনি ছেলেকে পুরাণে বর্ণিত দেবতা গণেশের তাঁর মা দেবী দূর্গাকে পৃথিবী জ্ঞানে প্রদক্ষিণ করার গল্প শুনাচ্ছিলেন। গল্প শেষে বললেন, ‘আসলেই মা হচ্ছেন সকল সন্তানের পৃথিবী। সত্যিই ভালোবাসার সমীকরণ অত্যন্ত জটিল।’
হঠাৎ করেই ড্রয়িং রুমে এসে আগের টুকু না শুনেই স্বামীকে বকুনি দিয়ে শারমিন বললেন, ‘কিসব ভালোবাসার কথা বলছ? বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেখছি তোমার লজ্জা-শরম ভয়ংকর হারে লোপ পাচ্ছে। আমার নাবালক ছেলের সাথে ভালোবাসা নিয়ে অলোচনা করছ।’
মমিন সাহেব খুব নরম গলায় বললেন, ‘আমরা দুজনে জ্ঞানের কথা অলোচনা করছি।’
শারমিন রেগে বললেন, ‘প্রতিদিন ছেলেটা পড়তে বসলেই তুমি এসে গল্প জুড়ে দেও। কিছুক্ষন পর তো আবার বাপ-বেটা মিলে খবর দেখবে। নাটক দেখবে। এরপর রাত জেগে সিনেমা দেখবে। এটা তোমাদের রোজকার অভ্যেস হয়ে গেছে।’ এই সব বলতে বলতে শারমিন চলে গেলেন।
লকডাউনে প্রতিদিন পিতা-পুত্রের পাঠশালার সান্ধ্যকালীন কার্যক্রম যথারীতি শুরু হয় ড্রয়িং রুমে। আজ মিশরের পিরামিড, মাসলোর মানব চাহিদার পিরামিড, আত্নপ্রকাশ, আত্মউৎকর্ষ, ফেরাউনের অত্যাচার ইত্যাদি কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে গল্প করছে দুজনে। গতকাল বাপ-বেটাতে মিলে ‘দ্য টেন কমান্ডমেন্টস’ ছবিটা দেখেছে। স্কুল বন্ধ। তাই পলিনের এখন আর বাঁধা-ধরা পড়াশোনার চাপ নেই। তোতা পাখির মতো স্কুলের পড়া মুখস্থ করার তাগাদা নেই। শারমিন এক ফাঁকে এসে চা-মুড়ি দিয়ে গেছে বাপ-বেটাকে।
গ্রীষ্মের খরতাপে মমিন সাহেবের বাগানের ফল পেকে গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। বাড়ির মূল ফটকের কাছের আমগাছটা এবারে বেশ আম ধরেছে। পলিনের রাত্রিতে খুব একটা গভীর ঘুম হয় না। অবশ্য, ভূতে ভয় নেই তার। তবে একাকী এই অরণ্যে কখনো কখনো চোরের ভয়ে তার গা ছমছম করে। রাতের গভীরে পলিন অনুভব করতে পারে কেউ একজন গেইটের কাছের আমগাছটাতে উঠছে। প্রথমে ভয়ে নিশ্চুপ ছিল। তারপর সাহস সঞ্চয় করে পলিন বাবাকে ঘুম থেকে ডেকে ওঠায়।
মমিন সাহেব ঘরের দরজা খুলে পা টিপে টিপে হেঁটে আমগাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। পলিনও বাবার পিছন পিছন গিয়ে গাছটার তলায় এসে দাঁড়াল। স্ট্রিট লাইট ও সিঁড়ি ঘরের লাইটের আলোর সমন্বয়ে দেখতে পায় কম বয়েসী এক ছেলে গাছে চড়ে আছে। আম পেড়ে পেড়ে কাঁধে রাখা বালতিতে রাখছে। গাছের তলায় যে পিতা-পুত্র দাঁড়িয়ে আছে তা সে তখনো টের পায়নি।
গেইটের বাহিরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে অত্র এলাকার সকলের সুপরিচিত ব্যক্তিটি যিনি কিনা নিজেকে চেয়ারম্যানের চাচাতো ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়ে বেড়ান। টের পেয়ে তিনি দৌঁড়ে পালালেন। অবশেষে গাছে চড়ে থাকা ছেলেটি আম ভর্তি বালতি নিয়ে মাটিতে নেমে এল। তাদেরকে দেখে ছেলেটি হতচকিত হয়ে গেল। ভয়ে দৌঁড়ে প্রাচীর টপকিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল।
মমিন সাহেব পিছন থেকে ডেকে বলল, ‘বাছির, তুমি পালাচ্ছ কেন? আমি চাবি নিয়ে আসছি। গেইটটা খুলে দিব। এভাবে পালাতে গিয়ে তুমি তো ব্যথা পাবে।’
বাছির বলল, ‘কাকা আমার কোনো দোষ নাই। চাচা আমারে নিয়া আইছে। আমারে ছাইড়া দেন। আর কোনোদিন আপনার বাড়িত চুরি করতে আমুনা।’
মমিন সাহেব বললেন, ‘তুমি ভয় পেয়ো না। ভালোই করেছ। দু-তিন দিন আগে আমগুলো পেকেছে। ভেবেছিলাম, কাউকে দিয়ে সেগুলো পেড়ে নিব। যাক বাবা, তুমি আমার কাজটা না বলতেই করে দিয়েছ। বাছির, এখন আমগুলো গুন তো দেখি।’
‘না কাকা, আপনে আমারে মাফ কইরা দেন। আমি আর কহনও চুরি কইরতে আপনার বাড়ি আমুনা।’
তিনি বললেন, ‘বাছির, তোমাকে আম গুনতে বলেছি। গুনতে না জানলে বলো। মাফ চাইতে বলিনি। কয়টা আমই তো নিয়েছ। তাও আবার এই অন্ধকার রাতে ঝুঁকি নিয়ে গাছে উঠতে হয়েছে। পুকুর-চুরি তো করোনি। কলমের সামান্য খোঁচায় এটা করা সম্ভব। শ্রমের প্রয়োজন নেই।’
পিতার এসব কথাবার্তার আগা-মাথা পুত্র কিছুই বুঝছিল না। বাছির বুঝেছিল কিনা সেই জানে। পলিন ভাবছে, ‘আমিই তো আমগুলো গুনতে পারতাম।’
বাছির ইতিমধ্যে আম গুনে শেষ করল। বলল, ‘চাচা, একশোটা।’
‘বাহবা, ঠিক একশোটা। ভালোই হলো, এখান থেকে তুমি পঞ্চাশটা আম নেও।’
‘না চাচা, আমার আম লাগব না। আপনে খাইয়া, আমার জন্য দোয়া কইরেন যাতে আমি ভালা হইয়া যাই। আপনে খুব ভালো মানুষ।’
‘না! তুমি আম নিয়ে না গেলে আমি গেইটের তালা খুলব না। চারদিক ফরসা হয়ে আসছে। সকাল বেলা লোকজন এসে তোমাকে এখানে দেখতে পেলে কি অবস্থা হবে তা তুমিই ভেবে দেখো। ও, ভালো কথা, তোমার চাচাকে অবশ্যই এখান থেকে পঁচিশটা আম দিবে কিন্তু।’
বাছির আম নিয়ে চলে গেল। পলিনকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন, ‘বাকি আমগুলো নিয়ে বাবা ঘরে যাও। তোমার মাকে কিছু বলার দরকার নেই। তাহলে টেনশন করবেন। নামাজে মনোসংযোগ হারাবেন। আমি গেইটে তালা দিয়ে আসছি।’
পরদিন দুপুরে এলাকার টং দোকানে পলিন চকলেট, চিপস, চানাচুর ইত্যাদি কিনতে যায়। বাছিরের চাচার সাথে দেখা। পলিনকে ডেকে বলল, ‘ভাতিজা, তোমাদের গাছের আমগুলা খুব মিষ্টি। তোমার বাবারে আমার সালাম দিও।’ পলিন বাসায় এসে বাবাকে বাছিরের চাচার সালাম পৌঁছে দিল। সবকিছু শুনে মমিন সাহেব বললেন, ‘যাক, ছেলেটা খুব বিশ্বস্ত।’
সন্ধ্যাবেলা থেকে মমিন সাহেবের শরীরটা ভালো লাগছিল না। এরকম তার প্রায়ই লাগে। তিনি শরীর খারাপের বিষয়টাকে খুব একটা আমলে নেন না। কারন, তার হার্টের সবকয়টা মেইন আর্টারিই প্রায় এক শ পার্সেন্ট ব্লক আছে। সুগার সব সময় হাই থাকে। উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিসের কারনে শরীরের সবকটা রগ ঢিলা হয়ে গেছে। তার এক বন্ধুর ডাক্তার ছেলে দেবী শেঠির হাসপাতালে চাকরি করে। তার মাধ্যমে মমিন সাহেব তার এনজিওগ্রামের সিডি এবং অন্যান্য চিকিৎসাপত্র উনাকে দেখিয়েছেন। দেবী শেঠি বলেছেন, মমিন সাহেবের বাইপাস সার্জারি করা যাবে না। নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে।
মমিন সাহেব আর কিছু মানুক না মানুক, তিনি প্রতিদিন এক জোড়া কলা খান। উনার শ্বশুর নাকি বিয়ের পরে বলেছিলেন, ‘বাবা, অন্য পথ্য খাও না খাও, রোজ দুটা করে কলা অবশ্যই খাবে। তাতে তোমার হার্ট ভালো থাকবে।’ এখনকার বিজ্ঞানের যুগে এর সত্যতা খুঁজে পেয়ে কোনো আলোচনায় কলার কথা উঠলে তিনি শ্বশুর মশাইয়ের প্রশংসা করেন। আর বলেন, ‘পুরাতন মানুষেরা আমাদের চেয়ে ঢের বেশি জ্ঞানী ছিলেন। কারন, তাঁরা পুস্তকের চেয়ে প্রকৃতির কাছ থেকে শিখেছেন বেশি।’
শারমিন রাতে শোবার সময় স্বামীর কপালে হাত দিয়ে দেখলেন। গায়ে কোনো জ্বর নেই। হার্টের কারনে আগে উনি প্রচুর কাশি দিতেন। আজ দু-তিন মাস ধরে একটা কাশিও দেন না। উনার ঠান্ডা লাগে না বললেই চলে। ঘরে বসেই আজ কোন গাছের ফল পেকেছে বলে দিচ্ছেন প্রতিদিন।
শারমিনকে আজ দুপুরে ডেকে বলেছিলেন, ‘পলিনের মা, মনে রেখ, আল্লাহ বাঁচাইলে কাল সকালে জামগুলো পাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। দরকার পড়লে, বাছিরকেই খবর দিতে হবে। তারপর আশপাশের সকলকে কিছু কিছু করে দিতে হবে। সবাইকে নিয়ে খাওয়ার মাঝে ভীষণ মজা, কী বলো প্রকৌশলী মিস শারমিন সুলতানা। না হয়, বাছির এসে এগুলোও আবার পেড়ে নিয়ে যাবে।’
পরের দিন সকালবেলা মমিন সাহেব ঘুম থেকে উঠেনা। শারমিনের ডাকে চিৎকারে তার ঘুম ভাঙে না। বরং তার কান্নার শব্দ শুনে প্রথমে পলিন, পরে একে একে প্রতিবেশীরা এসে জড়ো হয়। চেয়ারম্যান সাহেবও খবর পেয়ে গেছেন ইতিমধ্যে। উনি হয়তো এখনই লোকজন নিয়ে আসবেন।
‘কী করবেন?’ প্রতিবেশীরা এক অপরকে প্রশ্ন করছেন।
নিস্তব্ধ শারমিনের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে মুখে বেয়ে। একটি প্রশ্নই বারবার ঘুরে ফিরে উঠে আসছে তার মনে, ‘এটা কী সবুজ মৃত্যু, না কী লাল মৃত্যু?’
ফরিদ আহমদ : ৮ জুন, ২০২০