২৪ তম বিসিএস। প্রিলি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করি আমরা ক’জন বাল্য বন্ধু। পরীক্ষা শেষে সকলে আসে আরামবাগে আমার বোনের বাসায় আব্বাকে দেখতে। আব্বা তখন হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য ঢাকায় ছিলেন। মা আমাদের সাথে ঢাকায় ছিলেন। আমার বন্ধুদের সাথে বাবার খুব সখ্যতা ছিল। বিসিএস গ্রাইন্ডের শেষ কয়েকদিন বন্ধুরা আমাদের বাসায় এসে পড়তো। বাবা তাদের সাথে এসে যোগ দিতেন। বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যসহ সাধারণ জ্ঞানের অনেক প্রশ্নের উত্তর আব্বা দিতে পারতেন। তিনি বলতেন, ‘তোমরা বাংলা-ইংরেজী সাহিত্যের লেখকদের যে বইগুলোর নাম ও উক্তি মুখস্থ করছো, তার সবকিছুই আমার পড়া আছে। তাই এখনো মনে আছে।’
আব্বার কাছে শুনেছি তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় বই পড়ে কাটিয়েছেন। চট্টগ্রামে তাঁর এক পাবলিশার বন্ধু ছিলেন। বাবার চেয়ে বয়সে অনেক বড় ছিলেন তিনি। ১৯২০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করেন। তার বাসায় আব্বার সাথে একবার গিয়েছিলাম। বাসায় বুকশেলফ ভর্তি হাজারো বই। তিনি আমাকে বললেন ভাইপো, ‘আমার এই বইগুলো তোমার বাবার জন্য কেনা হয়েছিলো। তোমার বাবা বই ছেড়ে থাকতে পারতেন না। রোজ বিকেলে এসে বলতেন আজ কি বই কিনে এনেছেন আমার জন্যে। আর নতুন বই পেলে তা শেষ না করে মেসে ফিরতেন না।’
এখনকার ইন্টারনেটের যুগের মতো তখন প্রিলি পরীক্ষার পরপরই এমসিকিউ প্রশ্নের সঠিক উত্তর এতো দ্রুত মিলিয়ে দেখার সুযোগ ছিল না। তাই সবাই যে যেটুকু জানি বা গাইড বই থেকে মিলিয়ে দেখছিলাম কার কতো নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। হঠাৎ করেই আমার এক বন্ধু আবিষ্কার করলো, প্রশ্নের প্রথম দিকের একটি প্রশ্নের জবাব পরে দিবে ভেবে ওএমআর শীটের সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তরের জন্য বৃত্তাকার ঘর গুলো ফাঁকা রাখার বদলে সে ভুল করে পরবর্তী প্রশ্নের সঠিক উত্তরের জন্য নিবার্চিত বৃত্তাকার ঘরটি ভরাট করে ফেলেছে। ফলে, পরবর্তী প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তরের জন্য নিবার্চিত গোল্লাটি সে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের বদলে এর অগের প্রশ্নটির উত্তরের জন্য প্রদত্ত গোল্লাগুলোর মধ্য হতে একটি পূরন করে ফেলেছে। এতে করে তার বিশটির বেশী প্রশ্নের উত্তর সঠিক হবেনা বলে মনে হলো। সে হাউ মাউ করে কাদঁতে শুরু করলো।
মা আসরের নামায আদায় করে মাত্র সালাম ফিরিয়েছেন। মা আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার ও কাঁদছে কেনো। আমি বলার আগেই আমার বন্ধুটি মাকে সবিস্তারে সবকিছু বুঝিয়ে বললো। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। আমার মায়ের মন খুব নরম ছিল। সব মায়ের মন এই রকমেরই হয়। মা আমার বন্ধুর কথা শুনে তার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদতে লাগলেন এবং আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে বলতে লাগলেন ‘ হে আল্লাহ, তুমি এই প্রিলি পরীক্ষাটা বাতিল করে দাও। আমার বাবুর এক বন্ধু পরীক্ষাটা ভালো দিতে পারে নাই। সে ভুল করে ফেলেছে। আল্লাহ তুমি পরীক্ষাটা বাতিল করে দাও।’ আমার সেই বন্ধু অন্য রুমে চলে গেলে আমি বললাম ‘ও মা তুমি এ কি করছো। আমার পরীক্ষাতো ভালো হয়েছে। আমি পাস করবো।’ মা বললেন ‘তুই চিন্তা করিস না বাবা। তুই আবার পরীক্ষা দিলে আরো ভালো করবি। আর আমার ময়নাকে নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। কারণ তার বিফলতায় র্ধৈয্য ধারন করার ক্ষমতা আছে।’
সবশেষে, রাত আটটার খবরে দেখতে পেলাম ২৪ তম বিসিএস এর অনুষ্ঠিত প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনিবার্য কারণবশতঃ বাতিল করা হয়েছে। পরীক্ষার নতুন তারিখ পরে জানানো হবে। কেনো যে এমন হলো আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন। আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমানে আমার সেই বন্ধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক দায়িত্বশীল পদে কর্মরত আছেন। আর আমি দ্বিতীয় বারে বিরানব্বইটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছিলাম। আগের বারের তুলনায় চৌদ্দটি বেশি। আমি মনেপ্রাণে এ কথা বিশ্বাস করি যে, সন্তানের জন্য কোনো মায়ের দোয়াই আল্লাহর দরবারে কখনো বিফল হয়না।
হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী শুনি, তাদের দেবী দূর্গা একবার তাঁর সকল সন্তানদের ডেকে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে সবার আগে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসতে পারবে সেই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসো বলে আমি মনে করবো।’ এজন্য ভাই গণেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়তে হলো কার্তিককে৷ সকলে যার যার নিজ নিজ বাহন নিয়ে পৃথিবী প্রদক্ষিণে বেরিয়ে পড়লো। তাদের পুরাণ মতে, শিল্প ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক এবং বুদ্ধি ও জ্ঞানের দেবতা গণেশ চুপচাপ মায়ের চারদিকে ঘুরতে লাগলো। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাবা গণেশ তুমি যাবেনা? তখন সে বললো, ‘আমার মা হচ্ছে আমার পৃথিবী। তাই মা আমি তোমার চারদিকে পাক খাচ্ছি।’ মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘বুঝলাম তুমিই মাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসো।’ প্রতিযোগিতার অন্যরা ফিরে এসে দেখলেন তাদের আগেই বিজয়ীর সম্মান পেয়ে গিয়েছেন গণেশ। কারণ তিনি তাঁর মাকে পৃথিবীজ্ঞানে প্রদক্ষিণ করে সেই কাজটি ইতমধ্যে সেরে ফেলেছেন। ভালোবাসার সমীকরণ সত্যিই অত্যন্ত জটিল। আসলেই মা হচ্ছে সকল সন্তানের পৃথিবী। মায়ের মর্যাদা সকল ধর্মেই সুপ্রতিষ্ঠিত।
গত ১৩ মে ছিল আন্তর্জাতিক মা দিবস। মা দিবস কেন পালিত হয় আমার জানা নেই। হয়তো মায়ের প্রতি আমাদের করণীয়গুলোকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে। মায়েদেরও হয়তো নারী দিবসে গৃহীত বিভিন্ন প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে অধিকার আদায় করতে হবে কিনা জানিনা। স্কুল জীবনে আমরা সকলেই মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্যের বিষয়ে রচনা মুখস্থ করে এসেছি বিধায় এখন তাই বয়সকালে হয়তো তা ভুলে গেছি। ছোটবেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিষয়ে অধ্যয়নরত একজন এমএ শিক্ষার্থীর কাছে একবার শুনেছিলাম তাদের ক্লাসে রবি ঠাকুরের ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি’ কবিতাটি পড়ানো হয়েছে। অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘আব্বা, আমিতো এই কবিতা ক্লাস ওয়ানে পড়েছিলাম। এটা কেনো এমএ’তে পড়ানো হচ্ছে?’ আব্বা বললেন, ‘ওখানে হয়তো এই মর্মে পড়ানো হচ্ছে যে পরাধীনতার মেঘ কেটে স্বাধীনতার সূর্য উঁকি দিয়েছে। তাই স্কুল ছুটি থাকলে তোমরা যেমন খুশীতে আনন্দে কি করবে না করবে ভেবে পাওনা, তেমনি আমাদের স্বাধীনতা আমাদের জন্যে চরম আনন্দের মুক্তির বার্তা বয়ে এনেছে।’
আমার মনে হচ্ছে আমাদের টারশিয়ারী লেভেলের এডুকেশনে এধরনের দায়িত্ব কর্ত্যেবের বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্তির প্রয়োজন আছে। সব বয়েসী সন্তানের প্রতি ন্যানো সেকেন্ডের মুহূর্তে রয়েছে মায়ের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। আর মা হচ্ছেন একজন নারী। তাই আমাদের কারোরই মাকে তথা কেনো নারীকে কখনো জীবনের কোনো পর্যায়ে অশ্রদ্ধা করা উচিৎ হবেনা। মা আজ তুমি নেই কাছে অথচ আমার নিঃশ্বাসে বিশ্বাসে জীবন জীবিকায় তুমি আছো ওতোপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। হে আল্লাহ তুমি আমার মাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করো। আমিন।
ফরিদ আহমদ। ১৩ মে, ২০১৯