ব্রিটিশ আমলে লেখা সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের পণ্ডিত মশাইয়ের আটজনের পরিবার ও লাটসাহেবের তিনঠেঙে কুকুরের গল্প হয়তো আমরা সকলে স্কুলপাঠ্য বইতে পড়েছি । পণ্ডিত মশাই দারিদ্র্যজনিত কারণে খিটখিটে ছিলেন, বসতেন টেবিলে পা তুলে; ক্লাসে আসতেন ধুতি আর পৈতা পরে, ঊর্ধ্বাঙ্গের বস্ত্র কেনার সামর্থ্যও ছিল না তার। লাটসাহেবের স্কুল-পরিদর্শন উপলক্ষে পণ্ডিত মশাই একটা গেঞ্জি পরে এলেও অনভ্যাসে তার গা চুলকোচ্ছিল এবং খুলে টেবিলে রেখে দিয়ে গেঞ্জিটা পুনরায় পরেছিলেন লাটসাহেব আসার আগমুহূর্তে। লাটসাহেব চলে যাওয়ার পর এ নিয়ে হাসাহাসির এক পর্যায়ে তিনি ছাত্রদেরকে জানালেন লাটসাহেবের কুকুরটার এক পা ট্রেনে কাটা পড়েছিল; ঐ কুকুরের পেছনে মাসে খরচ পঁচাত্তর টাকা আর পণ্ডিতের মাসিক বেতন পঁচিশ টাকা, যা দিয়ে চালাতে হয় তাঁর নয় সদস্যবিশিষ্ট পরিবার। পণ্ডিতমশাই ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন- তিন পা-ওয়ালা কুকুরের পেছনে মাসিক খরচ পঁচাত্তর টাকা হলে পা-পিছু মাসিক খরচ কত এবং কুকুরের পা-পিছু মাসিক খরচ পঁচিশ টাকা হলে পণ্ডিত মশাইয়ের নয় সদস্যবিশিষ্ট পরিবারটি ঐ কুকুরের কয়টি পায়ের সমান?
গতকাল (৫ অক্টোবর, শুক্রবার) ছিল ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। এবারের শিক্ষক দিবসে হঠাৎ করে মনে পড়লো ছোটবেলায় পাঠ্য বইয়ে পড়ে আসা সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই দরিদ্র স্কুল শিক্ষক, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত মশাইয়ের গল্পের কথা। বেতন পেতেন পঁচিশ টাকা। আর লাটসাহেবের তিনঠেঙে কুকুরের জন্য ব্যয় হতো মাসে পঁচাত্তর টাকা। ব্রিটিশরা অনেক আগেই চলে গেছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানিদের পরাজিত করেছি। বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ । মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শুধু স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষানীতি (কুদরাত-এ–খুদা) রিপোর্ট দিয়েই তাঁর কাজ শেষ করেননি, তা বাস্তবায়নের যুগোপযোগী পরিকল্পনা-নির্দেশনাও দিয়ে যান। বর্তমানে, আমাদের অবস্থা অনেক বদলেছে। সেই গল্প এখন আর সত্যি নেই। সরকারি বা বেসরকারী সকল ধরনের, সকল স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় চাকুরী প্রত্যাশীদের আগ্রহ বেড়েছে অনেক। তরুণরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে । অনেকে শিক্ষকতা করে পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে চলছেন। বিত্তবৈভব করছেন। সমাজে এই ধরনের শ্রেণী-বৈষম্যের চিত্রগুলো অনেকটাই কমে এসেছে। পরিতাপের বিষয় হতে পারে যদি এমনটা হয় যে -অতিরিক্ত টাকার জন্য শিক্ষকরা শিক্ষকতায় মনোযোগ না দিয়ে যদি অন্য কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষার্থীরা এবং সমগ্র দেশ ও জাতি। সামগ্রিকভাবে ব্যাহত হবে শিক্ষার মান। অবশ্য উল্টো চিত্রও আছে। গ্রামেগঞ্জে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা বেশ বঞ্চিত অবস্থায়ই জীবন কাটান। হয়তো এসব শিক্ষকরা মাত্র দু চার হাজার টাকা বেতনে তাদের সংসার চালান। সেগুলো দূর করতে সরকার নিশ্চয়ই নানারকম উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নিয়েছেন ।
গতবারে শিক্ষাদিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘শিক্ষার অধিকার মানে হচ্ছে, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়ার অধিকার’। এর মাধ্যমে ইউনেসকো এটাই বলতে চেয়েছিল যে শিক্ষার অধিকার, প্রশিক্ষিত এবং যোগ্য শিক্ষক পাওয়ার অধিকার ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ শিক্ষকদের নিজের যোগ্যতা বাড়াতে হবে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘তরুণ শিক্ষকেরাই পেশার ভবিষ্যৎ’। ছোটবেলা থেকেই মুখস্থ করে আসছি শিক্ষকেরা হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। আর মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ মনে হচ্ছে তার সততা। বাবা শিক্ষক ছিলেন। শুনেছি, তখন বেশি কাজ ও অতি কম বেতনের কারণে শিক্ষকতা ছেড়েছেন অনেকেই । শ্রদ্ধেয় বড় ভাই শিক্ষক ছিলেন। আজ থেকে পনের বছর আগে অতি অল্প বয়সে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন তিনি। তাঁর ছাত্রদের সাথে দেখা হলে আজও চোখের জল মুছে মনে করেন তাদের প্রতি উনার অবদানের কথা, ভালোবাসার কথা। মনটা আনন্দে ভরে উঠে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিক্ষা প্রসঙ্গে বলে যাওয়া কথাগুলো একালেও আমাদের নতুন করে ভাবায়। “বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তিস্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তা হলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য (বিশ্বভারতী: ১১)।” এবং “ঘুরিয়া ফিরিয়া যেমন করিয়াই চলি না কেন শেষকালে এই অলঙ্ঘ্য সত্যে আসিয়া ঠেকিতেই হয় যে, শিক্ষকের দ্বারাই শিক্ষাবিধান হয়, প্রণালীর দ্বারা হয় না (পথের সঞ্চয়। শিক্ষাবিধি)।”
বিশ্বের প্রয়াত সব শিক্ষককে শ্রদ্ধাভরে এবং তাদের অবদানকে কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করছি।
ফরিদ আহমদ। ৬ অক্টোবর, ২০২০