ঊনপঞ্চাশ বছর আগে শীত জড়তার ঊনপঞ্চাশ বায়ুর নির্গমনে, প্রকৃতিতে ঋতুরাজ বসন্তের আগমনে —পরাধীনতা বোধের গ্লানিতে ক্লান্ত, শ্রান্ত, ঘুমন্ত মানুষদের হলো চোখ উম্মোচন। ঐ ফাগুনে ক্রমান্বয়ে উদ্দীপ্ত হলো — কত শত লক্ষ কোটি মুক্তিকামী মানুষ। এই মার্চ মাসেই বাঙালির স্বাধীনতার দ্বার খুলে দিয়েছিলেন একজন ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বিশাল এক জনসমুদ্রে এসে।
এভাবেই গণতন্ত্রের দ্বার উম্মোচিত হলো। এবং সিদ্ধ এক হাতের ইশারায় — বাংলাদেশের মানুষের অধিকার অর্জন, দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং বাঙালীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্য ছিনিয়ে আনতে লড়েছে সমগ্র দেশ ।
প্রতিটি মানুষ চেয়েছিল যাকে ছুঁতে, চেয়েছিল যাকে নিজের করে পেতে — তার নাম স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধ আমি দেখিনি । বিজয় অর্জন আমি দেখিনি। শুধু শুনেছি — একাত্তরের ঐ নয়টি মাস, পাকিস্তানী হানাদারদের জান্তব আক্রমণের বিরুদ্ধে, ঘরের শত্রু বিভীষণদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করে, কয়েক নদী রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি আমাদের স্বাধীনতা — বাঁচার স্বাধীনতা , মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারার স্বাধীনতা , হাসি-কান্নার স্বাধীনতা। দয়া নয় , দাক্ষিণ্য নয় , আমরা স্বাধীনতাকে করেছি অর্জন ।
আমরা ধন্য এই মাতৃভূমির জন্য। সুজলা, সুফলা, পুষ্প, পল্লব আর অরণ্যে ঘেরা আমাদের মাতৃভূমি যেন এক পরীর মত। সুভাগ্যক্রমে, আমার মায়ের ডাক নামটি ছিল রানী। সে অবিকল রানী — আমার মাতৃভূমি, জননী আমার । আমরা ধন্য হলাম, ওই দামাল দলের জন্য যারা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অটুট রাখল মা -মাটি’র লাবণ্য। মুক্তির রক্তিম সূর্যটাকে আনলো যারা জীবনানন্দ দাশের ধানসিঁড়িটির তীরে — এই বাংলায়।
প্রাচীন রোমান কবি ভার্জিল (খ্রিষ্টপূর্ব ৭০—১৯) বলে গেছেন, ‘সেই সবচেয়ে সুখী, যে নিজের দেশকে স্বর্গের মতো ভালোবাসে।’ কথাটির প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ছোটবেলায় স্কুলে শেখা এক সংস্কৃত প্রবচনেও, যেটাতে বলা হয়েছে, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী’, অর্থাৎ জননী জন্মভূমি স্বর্গের চাইতেও গরীয়ান। আরবি ভাষায়ও অনুরুপ একটি প্রবচন আছে, ‘আল্ হব্বুল ওয়াতান মিনাল ইমান’, অর্থাৎ দেশপ্রেম হচ্ছে ইমানের অঙ্গ।
ডি এল রায়ের, ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা/ ও সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা/ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’ পরীর মত, রানীর মতো এই দেশ আমাদের আরাধ্য। আমাদের প্রাপ্তি। আমাদের অর্জন।
পরাধীনতার পর এসেছে আমাদের সুদিন। আজ আমরা স্বাধীন — অনেক ত্যাগের পরে। অনেক তিতিক্ষার পরে। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। স্কুলের মুখস্থ করা ভাবসম্প্রসারণ: স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন — সত্যি সত্যি সত্যি। তিন সত্যি।
স্বাধীন হবার জন্য যেমন সাধনার প্রয়োজন, তেমনি স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়ণতা। এ স্বাধীনতা যেন কোন কারনে কখনো খর্ব না হয়, ভূলুণ্ঠিত না হয় — মহান রাব্বুল আলামিনের কাছে নিশ্চয়ই এই প্রার্থনা করে সতত মাতৃসম জন্মভূমির সকল বঙ্গ সন্তান।
প্রিয় জন্মভূমি — তুমি কষ্ট করে পাওয়া আমাদের একমাত্র অর্জন — আমাদের ভালোবাসা।