সহজ সরল ভাষায় রচিত কল্পিত এক অসমাপ্ত প্রেমের গল্প “পুরানো সেই দিনের কথা”। পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
ক্রনিক চোখ ব্যথার জন্য তৌকি ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকাত না বললেই চলে। কারো সাথে কথা বলার সময়েও পারলে চোখ বুজে রাখে। সহপাঠিনীদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়না। শহুরে এক ছেলেকে সহপাঠীরা রীতিমত লেভেন্ডিস বলেই ডাকতো।
মেশিন ল্যাবের কুইজ পরীক্ষার নম্বর বোর্ডে টানানো হয়েছে। তৌকি ত্রিশে তিন পেয়েছে। ক্লাস রুম সংলগ্ন লনে দাঁড়িয়ে সবাই কুইজের নাম্বার নিয়ে আলোচনা করছিল। তৌকির মন খুব খারাপ। কারন কুইজের নাম্বারের উপর ল্যাবের গ্রেডটা নির্ভর করে। করিডোরে দাঁড়িয়ে দু একজনের সাথে হাপিত্যেশ করছিল।
সর্বোচ্চ মার্কস কে পেয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সাকিব লনের দিকে দেখিয়ে বললো, “ঐ যে কালো মেয়েটি, খুব হাসছে যে, সে পেয়েছে। তুইতো আবার কারো দিকে তাকিয়ে কথা বলিস না। এখনই তো ওর নাম জানতে চাইবি। ও হচ্ছে সনম।” ব্যথায় ছোট হয়ে থাকা চোখগুলোকে বিস্ফারিত করে অপলক দৃষ্টিতে তৌকি সনমের দিকে তাকিয়ে রইলো। সনমের চেহারার বুদ্ধিদীপ্ত আভা আর ঠোঁটে লেগে থাকা দুর্দান্ত হাসি তৌকির মস্তিস্কে এক দুর্নিবার আকর্ষনের জন্ম দিলো। তৌকি নিজেকে প্রশ্ন করছিল, “আমি কি সত্যিই তাকে পছন্দ করে ফেলেছি।” উত্তর এলো, “জানিনা।” “তবে কেন তাকে নিয়েই ভাবতে ভালো লাগছে। তার চারপাশেই যেন থাকতে ইচ্ছে করছে।”
সনমের সিল্কি চুল, স্নিগ্ধ হাসি, ত্রুটিহীন শরীরে লেপ্টে থাকা অতি রঙিন পোশাকের কোনটাই তৌকির মিটিমিটি চোখ থেকে সরছিলনা। দৃষ্টি সীমানার বাইরে গেলেই সনমকে না দেখা পর্যন্ত তৌকির চোখদুটি শুধু তাকেই ক্যাম্পাসের সর্বত্র খুজেঁ বেড়াতো। সনমকে চোখে চোখে রাখার একটা আসক্তির জন্ম নিয়েছিল তৌকির মাঝে। ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করার ফাঁকে দু একটা কথা হতো তাদের মাঝে। সাকিব বললো, “দোস্ত, তুই একটা বাঘিনীর প্রেমে পড়েছিস। পড়াশুনা ছাড়া সে কিছু বোঝেনা। আমরাও প্রথম প্রথম ক্রাশ খাইছিলাম। এ বিষয়ে সে খুব নিষ্ঠুর।”
এক সকালে করিডোরে তৌকি একা দাঁড়িয়ে ছিল। সনম এসে মিষ্টি হেসে বলল, “কেমন আছো, তৌকি?” সূক্ষ্ম একটা অনুভূতি তৌকির মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কোন ভূমিকা না দিয়ে সনম তৌকিকে দুপুরে ক্যাফেটেরিয়ায় তাঁর বার্থডে পার্টিতে থাকতে বলল। “আমরা বন্ধুরা সবাই সেখানে থাকবো। তুমি এলে আমি খুব খুশী হবো।” এ বলে সনম করিডোর থেকে ক্লাসে ঢুকে পড়লো।
তৌকির ঘনিষ্ট বন্ধুদের কেউই আমন্ত্রিত হয়নি। “আমার কি সনমের পার্টিতে যাওয়া উচিত হবে? কেউ যদি তখন আমাকে লেভেন্ডিস বলে ডাকে, ওর সামনে ভীষন লজ্জা পেতে হবে। আর যেতে হলে কিছু একটা গিফট কিনতে হবে। সবকয়টা ক্লাসেই যে আজ ক্লাস টেস্ট আছে।” তৌকি কেমন জানি একটা ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগছিল। তার যাওয়া হলোনা।
আজকাল সনমের চোখে মুখে ক্ষোভ, রাগ, দুঃখ, হতাশার ছাপ উপচে পড়ছিল। “এটাই স্বাভাবিক। আমি তার বন্ধুত্বের মূল্য দেয়নি, তার প্রসারিত হাত ধরতে পারিনি। এর জন্য আমিই দায়ী। “এই ভেবে তৌকি ঠিক করলো সসৃষ্ট দুরত্ব কমাতে হবে।
সনমের জন্মদিন ফিরে এলো। পুরো দিনটা কেটে গেল। কোন কথা হলো না। শুভেচ্ছা জানাতে তৌকি একটু সুযোগও পেলোনা। রাতের অন্ধকার হাজির। এই প্রথম তৌকি তাকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিলো। হলের কয়েন বক্স ফোনে আটআনার মুদ্রা ডুকিয়ে সনমের ল্যান্ডফোনের সংযোগ পেল। তৌকি বলল, “শুভ জন্মদিন। মেমের জন্মদিনের আমন্ত্রণ পাইনি।” সনম তত্ক্ষণাত জবাব দিল,“আমি এবার জন্মদিন পালন করছিনা।” তৌকি বলল, “দুঃখিত, আমি গত বছর আসতে পারিনি।” তৌকি ভেবেছিল তার কলটি পেয়ে সনমের মন নরম হবে। এই সুযোগে গতবারে সে কেন আসেনি তা বুঝিয়ে বলবে। গম্ভীর গলার উত্তর এলো, “কোন সমস্যা নেই। আমি এখন রাখছি।”
পরেরদিন বিকেলে সনম বন্ধুদের নিয়ে ল্যাবটরিতে যাচ্ছিলো। সনমকে দেখে তৌকির খুব নার্ভাস লাগছিল। তৌকির দিকে চোখ পড়তেই সনম দুষ্টু মিষ্টি হাসি দিলো। মুখচোরা তৌকি হাসি দিয়েই জবাব না দিয়ে খুশী লুকিয়েছিল। অন্যরা যাতে কিছু না বুঝে।
“কতদিন নিজের মনের ভাব এভাবে লুকিয়ে রাখব? যদি তাকে প্রপোজ করি তার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে?” তৌকির দিন কাটছিল এরকম ভাবনায়। ল্যাব মেটদের একদিন বলেই ফেললো, “আমি সনমকে ভালোবাসি।” তারা প্রথমে চুপ করে গেলেও পরে খুনসুটি করে বলল, “ এক্ষুনি বুঝলাম, গুরু ল্যাবে কাজে ফাঁকি মেরে ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো কেন? রসায়ন ল্যাবের রসায়ন। সাহস করে বলেই ফেলনা টাইগ্রেসকে।” “আমি ভীষন ভয় পাচ্ছি, সাকিব।” “বেলা যে ভয়ে গেল, জলকে চল। উড়ে চলে গেলে পরে পস্তাবি বন্ধু। চিরকাল আফসোস করবি।”
সনমকে হারাবার ভয় তৌকিকে পুড়ে মারছিল প্রতিটি নিদ্রাহীন রাতে। বার্নসের “আউল্ড ল্যাং সাইনে” কবিতা আর কবিগুরুর “পুরানো সেই দিনের কথা” গান গুনগুনিয়ে রাত কাটাতো। স্ট্রিটলাইটগুলি নিভে যাওয়ার পর অন্ধকার ভেঙ্গে সূর্যের আলো দেখার অপেক্ষায় থাকতো।
সিদ্ধান্ত নিল সনমকে একটা চিঠির মাধ্যমে মনের সব কথা জানাবে। গ্র্যাজুয়েশনের শেষ দিনগুলির চূড়ান্ত গণনা তৌকির জৈবিক ঘড়িতে শুরু হলো। তখনো হীনমন্যতায় ভুগছিল তৌকি। তাই চিঠিতে কবি জসীমউদ্দীনের নিমন্ত্রন কবিতার গ্রামের বন্ধুর অনুকরনে এক সাদামাটা সম্ভাবনাময় সুন্দর সৎ জীবনের স্বপ্ন সনমকে সে দেখিয়েছিল। লিখেছিল, “ইচ্ছে হলে তোমার অবস্থান থেকে নিচে নেমে এসে আমার কাছে আসতে পারো। প্রাচীন গ্রীক অলিম্পিকের জলপাই পাতার মালা দিয়ে আমরা একে অপরকে বরন করে নিতে পারি।”
অবশেষে, একদিন লেভেন্ডিস তৌকি —অত্যন্ত সুন্দরী, বুদ্ধিমান ক্লাসমেটকে দীর্ঘ এক প্রেমপত্রের মোহনীয় ভাষা, ছন্দ আর শব্দের যাদুতে ভালোবাসার কথা জানিয়েছিল। পাদটীকায় ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছিল তৌকি।
কিছুদিন পর ফোন করেও বলেছিল, “সনম, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। তোমাকে না দেখে থাকতে পারব না আমি। এতোদিন বলিনি যাতে তোমার পড়াশুনার ক্ষতি না হয়।” উত্তরে সনম বলেছিল “ আমি সবে ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেছি। এখনো গুছিয়ে উঠতে পারিনি।” তৌকি বলেছিল, “তুমি আমাকে না বলে দিলে এ বিষয়ে আর তোমাকে বিরক্ত করব না।” সনম তৌকিকে বলেছিল, “আমি তোমাকে কখনও না বলব না।”
তৌকি আবার কয়েকদিন পর ফোন করে জানতে চাইলে সনম বলেছিল, “আমি এখনও সবকিছু গুছিয়ে উঠতে পারিনি।” পরের সপ্তাহে কথা প্রসঙ্গে তৌকি ফোনে বলল, “সনম, এখন আমেরিকান এম্বেসী সুটেন্ড ভিসা একদম দিচ্ছে না।” উত্তরে সনম হাসি দিয়ে বলেছিল, “চিন্তা করোনা, আমরা যখন দাঁড়াবো তখন ভিসা পেলেই হলো। আগামী সপ্তাহে ডিপার্টমেন্টে এসো।”
সনম প্রতিরাতে চিঠিটি পড়ে টেবিলে রাখে। সকালে মামনি এসে পড়ুয়া মেয়ের টেবিলের এলোমেলো বইখাতা গুছায়। তিনি একদিন ময়লা কাগজ ভেবে চিঠিটি ফেলে দিলো। সনমের অবচেতন মনে তৌকির চিঠির কথাগুলির বারবার অনুরণন হচ্ছিল। তৌকির সাথে কথা বলার জন্য সনমের মন আনচান করছিল। তৌকিকে দেখার জন্য সনম উতলা হয়ে উঠল।
সনমের পিতামাতা চিন্তায় ভেঙ্গে পড়লেন। কারন তাদের মেয়ে সকল বিয়ের প্রস্তাব নানারকম অজুহাতে প্রত্যাখ্যান করেছিল। তৌকির কথা তারা জানতে পারলেন। তাকে খোঁজার নানারকম চেস্টা করলেন। অবশেষে, সনমের জন্য পাত্র চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দিলেন এই আশায় যদি তৌকি খোঁজ পেয়ে আসে। এতে সনম সম্মতি দিয়েছিল এই শর্তে যে সে তৌকিকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবেনা।
তৌকি আর কখনো ডিপার্টমেন্টে আসেনি। ফোনও করেনি। কারন সে নির্জনে নিভৃতে গ্রাম সদৃশ এক শহরের ছোট্ট এক চিলেকোঠায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী অসুস্থ জীবন যাপন করছিলো।
ফরিদ আহমদ। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০