Skip to content

দিনলিপি

    স্বাগতম ইংরেজী নববর্ষ ২০২০।

    সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই। আমাদের জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো স্বস্তিতে-শান্তিতে কাটুক, আলোয় আলোয় স্নাত থাকুক। নতুন বছরে নতুন করেই আমাদের ভিতরে জেগে উঠুক পরস্পরের জীবনে আলো জ্বালাবার প্রত্যাশা। নতুন বছরের সূচনায় আনন্দের সঙ্গে দীপ্ত চেতনায় সকলে শপথ নেই — আমরা সবাই মানবিকবোধকে সমুন্নত রাখব। আমরা অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করব না। কাজ করে যাবো মানবকল্যাণে। দিনবদলের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও যেন হাঁটতে পারি অন্ধকার ছেড়ে আলোর পথে। লিখতে পারি যেন দিনলিপিতে আমাদের প্রত্যেকের সৎ সত্যি সুন্দর যাপিত জীবনের গল্প।।

    ‘দিনলিপি’

    “দুই কান্দে দুই মুহূরি/ লিখতে আছেন ডাইরি/ দলিল দেইখা রায় দিবেন/ টাকা পয়সার নাই কারবার।” ১৯৭৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত বাংলা ছবি “গোলাপী এখন ট্রেনে”র জন্য গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের রচিত “আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার” গানের চারটি লাইন। প্রথম লাইন দুটিতে তিনি নিশ্চয়ই -মানুষের কথা, আমল ও নিয়তসমূহ তথা বান্দার আমলনামা লিখার কাজে নিয়োজিত সম্মানিত ফেরেশতাবৃন্দ কিরামুন কাতিবীনের কথাই বলেছেন। তাঁদের প্রতি নির্দেশ এইরুপ যে, কোন মানুষ যদি পাপকর্ম করার সংকল্প করেন তাহলে উক্ত ব্যক্তি ঐ কর্ম সম্পাদন করার পূর্ব পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আমলনামায় সেটি লিখবে না। যদি সংকল্পকৃত কাজটি সে সম্পাদন করে ফেলেন তাহলে কাজের অনুরূপ একটি পাপ তার আমল নামায় লিখবেন। আর যদি আল্লাহর সম্মানে উক্ত পাপ কাজ তিনি পরিহার করে সংকল্প পরিবর্তন করেন, তাহলে সেটিকে একটি পরিপূর্ণ হাসানাহ তথা নেককাজ হিসাবে তার আমল নামায় লিখে নিবেন। আর যদি সে কোন ভালো কাজ করার সংকল্প করেও তা কাজে রূপান্তরিত না করেন তাহলে এর বিনিময়ে তার আমলনামায় একটি পরিপূর্ণ হাসানাহ লিখবেন। আর তিনি যদি উক্ত কাজ সম্পাদন করেন তাহলে ঐ এক কাজের বিনিময়ে অনুরূপ দশ থেকে সাতশতগুণ আমলের বা সৎ কাজের ছাওয়াব তার আমলনামায় লিপিবদ্ধ করবেন। ফেরেশতাবৃন্দের এ ডাইরি লেখার বিষয়ে আমরা বিশ্বাসীরা সকলেই অবগত আছি।

    এবারে ডাইরি বিষয়ে স্কটিশ সাহিত্যিক স্যার জেমস মেথিউ বেরির বিখ্যাত উক্তিটি বাংলায় নিজের মতো করে উদ্ধৃত করছি , “প্রত্যেকটি মানুষের জীবন একটি ডায়েরি যার মধ্যে সে একটি সত্যি গল্প লেখার চেষ্টা করে, অতঃপর তার মর্মার্থ খোঁজে, এবং পরিবর্তন -পরিবর্ধন করে অন্য আরেকটি গল্প লিখে; আর জীবনের অতীব র্দুবল মুহূর্তে, জীর্ণশীর্ণ দেহে কোমল মনে, বিনম্র সংযত চিত্তে নিজের লেখা ডায়েরীর পাতার সাথে তার জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং তা পূরণের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ ও প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির সাথে নিজের কৃত কর্মের তুলনা করেন।”

    খুব বেশী দিন আগের কথা নয় কাগজে কলমের ছোঁয়ায়, হাতের লেখায় পড়াশুনা সহ ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক সব কাজ সম্পন্ন হতো। রোজকার কাজ শেষে অনেকেই রাতে ঘুমাবার আগে ডায়েরি লিখতে বসতেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে রোজনামচায় সারাদিনের টু-ডু লিস্ট অন্তর্ভূক্ত করে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তেন। ছাত্র জীবনে আমার এক ঘন‌িষ্ঠ বন্ধুর প্রকৌশলী পিতা প্রতি মাসে আমাকে সৌদি আরব থেকে বারো তেরো পৃষ্ঠার চিঠি হাতে লিখে পাঠাতেন। আর বর্তমান সময়ে আমরা বড় হচ্ছি কম্পিউটারের কি বোর্ডের বোতাম টিপে টিপে বা স্মার্ট ফোনের টাস স্ক্রীন আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে।
    কাজে অকাজে আমরা সবাই এখন খুব বেশী ব্যস্ত। সকল প্রকার কর্মের পরিধি ও পরিসর অনেক গুনে বেড়েছে । তাই ব্যক্তিগত ও দাপ্তরিক যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করছি ছোট ছোট টাইপড টেক্সট মেসেজ বা মেইল। আমার শ্রদ্ধেয় স্যারতো আমাকে একদিন বলেই বসলেন আপনার এতো লম্বা মেইল পড়ার সময় আমার নেই। মেইলে আমি যে বিষয়টি স্যারকে অবহিত করতে চেয়েছিলাম তা আমার পক্ষে এর চেয়ে অল্প কথায় লেখা সম্ভব ছিলনা। ফোন করে অনেকেই বলেন ডিটেলস পড়ার জন্য এতো সময় হাতে নেই। দুই এক শব্দে টেক্সট মেসেজ পাঠান। তাই নতুন একটা বিষয়ের সাথে ইতিমধ্যে পরিচয় হয়েছে আমাদের সকলের-পিচিং । বিজনেস সার্ভিসে বা প্রজেক্ট সাবমিশনে প্রকল্প পরিচালককে বা অফিসের বসকে বুঝাতে । আর অবশ্যই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নার্ভ ঠিক রেখে সময়ের সীমাবদ্ধতা মেনে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পিচিং করতে হবে। সময়টুকু সাধারনত দুই বা তিন মিনিটের বেশী হবেনা।

    সবকিছু্ ঠিক আছে মানছি। লম্বা লম্বা ডকুমেন্ট এখন আর হাতে লেখার সময় বা ইচ্ছা কারোর নেই বা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়না। কিন্তু দিন শেষে ডায়েরিতে দু একটা পাতা বা অনুচ্ছেদ বা বাক্য অন্তত আমাদের সকলের লেখা উচিত। এভাবেই লিখা হবে আমাদের প্রত্যেকের যাপিত জীবনের ইতিহাস। আর আমরাই হবো আমাদের কৃত কর্মের গল্পকার বা আমলনামার অনুলিপিকার। নিজেকে জানার চেনার বা আবিষ্কার করার এটিই সবচেয়ে উত্তম উপায়। নিজের লেখা দলিলের দেহের ভাঁজে ভাঁজে জমে যাওয়া ময়লা দূর করে দেহের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা ও মনের পবিত্রতা অর্জন করা সম্ভব। স্ফটিকের মত পরিস্কার হয়ে ভেসে উঠবে দলিলের লাইনে লাইনে এ যাবৎ আমরা কি করেছি, ভবিষ্যতে আমাদের কি করা উচিৎ আর কি করা অনুচিত। নিজের পরিচয় নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে ঠিক যেমনটি আমরা আয়নাতে দেখতে পাই নিজের চেহারা । অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই যদি এমনটা হয় যে দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ নিজের কর্মকান্ড নিজেকে নিজের কাছেই ভন্ড শঠ ঠগ হিসেবে পরিচিত করে। হতে পারে হয়তো কঠিন অনুতাপ। আর বিবেকের তাড়নায় শুধরে নিতে পারি হয়তো নিজেকে।

    এ যাবৎ করা সব ভুল একসাথে শুধরানোর চেষ্টা করার নিতান্তই বোকামী। তাতে নিজের মন্দ স্বভাব বা বদ অভ্যাসের সাথে জড়িয়ে পড়া রণে ভঙ্গ দিতে পারি আমরা সকলে। ফুরিয়ে যেতে পারে আমাদের উদ্যম। আমরা সকলে প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন কারনে শপথ নেই- আজ থেকে আর কোন মন্দ কাজ করবোনা। কিন্তু পারিনা। একসাথে হাজারটা মন্দ অভ্যাস বা খারাপ কাজ ত্যাগ করা পার্থিব জীবনে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে কখনোই সম্ভব হয়না। অতি তুচ্ছ একটা উদাহরন দেই, ধরুন প্রতিদিন একটা করে সিগারেট আগের দিনের চেয়ে কম খাবেন, একদিন তা শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। কলিগদের সাথে আরো সহনশীল হবেন। ছোট বড়ো কারো সাথে আর খারাপ ব্যবহার করবেননা। একটার পর একটা বদ অভ্যাস জীবন থেকে ছেঁটে ফেলবেন। একটা সময় পর অবশ্যই নিজেকে নতুন ভাবে নতুন রুপে আবিষ্কার করবেন।

    এবারে বলি, আমাদের সংক্ষিপ্ত জীবনে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ছোট ছোট বদ অভ্যাস বা স্বভাবগুলো অন্বেষন করে এভাবে শুদ্ধ করতে থাকলে বড় বড় অনৈতিক কাজ গুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করার সময় হয়তো আর অবশিষ্ট থাকবেনা। তাই এমন দু একটা বদ অভ্যাস ত্যাগ করার অনুশীলন করতে হবে যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে অন্য সব ছোট বড় দোষ গুলোকে তাড়িয়ে দিবে। বেশীর ভাগ ধর্মীয় অনুশাসন সদা সত্য বলাটাকে এধরনের একটি অভ্যাস হিসেবে চিহ্নিত করেছে যা মানুষকে মোটামুটি সব পাপ থেকে মুক্তি দিতে সক্ষম। পুলিৎজার পুরুস্কার প্রাপ্ত লেখক চার্লস ডুইগ তাঁর “দি পাওয়ার অব হেভিট” বইয়ে এ জাতীয় অভ্যাস বা ঝোঁক গুলোকে সুর স্বভাব বা চরিত্র গঠনের প্রধান ভিত্তি প্রস্তর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এধরনের অভ্যাসগুলো জীবনের সব খারাপ কিছুকেই উল্টে-পাল্টে আমাদেরকে সাদা মনের মানুষে পরিণত করতে পারে। ডায়েরির পাতায় আমাদের জীবনের সত্য ও সঠিক ইতিহাস লিখার মাধ্যমে, নিজের বিবেকের কাছে রোজনামচায় লিপিবদ্ধ নিজের কৃত কর্মের হিসাব দেয়ার মাধ্যম নিজেকে শুধরে নিয়ে আমরা অর্জন করতে পারি এ জাতীয় সুর স্বভাব বা চরিত্র গঠনের প্রধান ভিত্তি প্রস্তর।

    “কারাগারের রোজনামচা” জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা একটি ডায়েরির গ্রন্থরূপ। ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে এবং পুলিশের বিশেষ শাখার সহায়তায় উদ্ধার করা হয় এই ডায়েরিটি। এতে ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ঘটনাবহুল জেল-জীবনচিত্রের সাথে সাথে কয়েদীদের জেল-যন্ত্রণা, তাদের অজানা কথা, অপরাধীদের কথা, কেন তারা এই অপরাধ জগতে পা দিয়েছিলো, তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারাগারে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের দুঃখ-দুর্দশা, গণমাধ্যমের অবস্থা, শাসক গোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন, ছয় দফার আবেগকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা, ষড়যন্ত্র, বিশ্বাস ঘাতকতা, প্রকৃতি প্রেম, পিতৃ-মাতৃ ভক্তি, কারাগারে পাগলদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার চিত্রও এ গ্রন্থে স্থান পেয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতে বাংলার মানুষ যে স্বাধীন হবে এ আত্মবিশ্বাস বারবার বঙ্গবন্ধুর লেখা ডায়েরীতে ফুটে উঠেছে। এতো আত্মপ্রত্যয় নিয়ে পৃথিবীর আর কোনো নেতা নিজের জন্মভূমির স্বাধীনতার অর্জনের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পেরেছেন কিনা বলে তাঁর জানা নেই বলে তিনি জানান। ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতা অর্জনের সোপানগুলি যে কত বন্ধুর পথ অতিক্রম করে এগুতে হয়েছে তার কিছুটা চিত্র এই কারাগারের রোজনামচা বইতে ফুটে উঠেছে।

    ১৯৭১ সালে লেখা বেগম সুফিয়া কামালের দিনলিপিতে উঠে এসেছে একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের নানা মুহূর্ত। পরবর্তীতে তার ডায়েরিটি “একাত্তরের ডায়েরি” নামকরনে বই হিসেবে মুদ্রিত হয়। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধা শহিদ রুমির মা জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনলিপি বই আকারে “একাত্তরের দিনগুলি” নামে ছাপা হয়। শত বিতর্ক ও বিভ্রান্তির মাঝেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা কিশোরী অ্যানার ডায়েরি, যা পরবর্তীতে ‘অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ নামে বই হিসেবে মুদ্রিত হয়। এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত বইগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। ইউরোপ ও আমেরিকার স্কুলগুলোতে পাঠ্যপুস্তকের তালিকায় ‘অ্যানা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ বইটি স্থান করে নিয়েছে। ১৯৪২ সালের ১২ জুন অ্যানা তার তেরতম জন্মদিনে ডায়েরিটি উপহার পেয়েছিল । ঠিক ঐ দিন অর্থাৎ ১২ জুন, ১৯৪২ থেকে ১ আগস্ট, ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত সময়কার তার জীবনের ঘটনাগুলো উক্ত ডায়েরিটিতে সে লিপিবদ্ধ করেছিল।

    কে জানে আপনার আমার লিখিত দিনলিপিও কোন একদিন বই হিসেবে মুদ্রিত হয়ে যেতে পারে। মনে প্রাণে দৃঢ় ভাবে আমি বিশ্বাস করি উপরে বর্নিত বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের কেউই বই মুদ্রনের উদ্দেশ্যে তাঁদের রোজনামচা লিখেননি।

    এখন অবশ্য ডায়েরি লেখাটা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা বেশীর ভাগ মানুষই অন্যের মর্জি বা ইচ্ছা পূরণে ব্যস্ত বা সহজ কথায় অন্যকে নিয়ে ব্যস্ত। ঘুমাতে যাওয়ার আগে, ঘুম থেকে উঠে কাল বিলম্ব না করে চেক করে নেই ফোন কল লিষ্ট বা মেইল বা ফেসবুক মেসেঞ্জার। হাত মুখ না ধুয়ে প্রাতরাশ না করেই ঢুকে পড়ি ফেসবুকে। নতুন কোন পোস্ট বা নিউজ ফিডের অন্বেষণে। সুযোগ পেলেই এমনকি ডাইনিং টেবিলে মধ্যাহ্ন ও নৈশ ভোজ খেতে বসেও আমরা এটিই করি। এবং এটিই করি সারা দিনমান। এ বিষয়ে ধৈর্যের বা আসক্তির কোন ঘাটতি নেই। অন্যের ইনপুটই নিজের আউটপুট হয়ে বের হয়। এতে করে নিজের সৃষ্টিশীলতা বা সক্ষমতা লোপ পাচ্ছে।

    সৃষ্টিশীল কিছু করতে হলে অবশ্যই এই আসক্তি থেকে মুক্ত হতে হবে। এজন্য দশ বিশ মিনিটের বেশী সময় বরাদ্ধ রাখা ঠিক হবেনা। পিচিং এর মতোই খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। অথবা দিনে কয়েক বার অল্প সময়ের জন্য ঘুরে আসতে পারি অধুনা তরুনদের অতি প্রিয় পুরো ফেসবুকের বিস্ময়কর বিশ্ব। ভীষণ ঘরকুনো লেখক জুলভার্নও সবচেয়ে কম কত দিনে বিশ্ব ভ্রমণ করা সম্ভব তার পরিকল্পনা করেছিলেন। জুলভার্ন দীর্ঘ ৪০ বছর নিজের বাড়ির ছোট্ট এক চিলতে চিলেকোঠায় বসেই অধিকাংশ বই লিখেছেন। সেখান থেকে খুব একটা নড়াচড়ার নামও তিনি নিতেন না। তবে সেই চিলেকোঠাতেই ঠাসা ছিল সারা বিশ্বের মানচিত্রসহ নানা নথিপত্র। সেসব দেখে আর পড়েই জনপ্রিয় সব বিজ্ঞান কল্পকাহিনি আর অভিযানের কাহিনি লিখে গেছেন জুল ভার্ন। শেষে কিনা ফিলিয়াস ফগকে দিয়ে তিনি মাত্র আশি দিনেই পুরো বিশ্ব ভ্রমন করিয়ে ছিলেন তাঁর “আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ” বইয়ে।

    সুকুমার রায়ের রচিত শিশু সাহিত্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে দু একটি লাইন এখানে উদ্ধৃত করছি — “আমাদের শরীরের ভিতরকার শক্ত কাঠামোটিকে আমরা কঙ্কাল বলি। কঙ্কালটা ভিতরে থাকে আর এই রক্ত মাংসের শরীর তাহাকে ঢাকিয়া রাখে। আর শামুক ঝিনুকের কঙ্কালটা থাকে শরীরের বাহিরে। শামুক ঝিনুকের মতো নিতান্ত সামান্য জিনিসের মধ্যে যে কত আশ্চর্য ব্যাপার লুকান থাকে, ভাবিলে অবাক হইতে হয়। তাহাদের অনেকেই সারা জন্ম মাটি আঁকড়াইয়া পড়িয়া থাকে। একরকম পোকার জ্বালায় অস্থির হইয়া ঝিনুকের গায়ে রস গড়ায় আর সেই রস জমিয়া মুক্তা হয়।”

    নিজের জন্য শামুক ঝিনুকের মতো একটা জগৎ সৃষ্টি করে তাতেই ডুবে থাকিনা কেন। অন্তত কিছু পুরাতন ভালো অভ্যাসকে নতুন সভ্যতার অগ্রযাত্রার ও আগ্রাসনের মাঝেও ঝিনুকের মতো আঁকড়িয়ে পড়ে থাকি। অশুভ জ্বালায় অস্থির না হয়ে মুক্তার মতো মূল্যবান কিছু সৃষ্টি করি। ডায়েরিতে তিন আঙ্গুলে লিখা লাইনগুলো শুধুই ইতিহাস হয়ে থাকেনা , গবেষকদের মতে এই অনুশীলনের মাধ্যমে বৃদ্ধি হয় আমাদের স্মৃতিশক্তি বা স্নায়ুবিক বল যা কিবোর্ড প্রেস করার মাধ্যমে হয়না। স্বরচিত দিনলিপি আবিষ্কার করে ফেলতে পারে আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত লেখককে।
    কোন ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সুরে সুরে শুরু করেই দেইনা কোন বন্ধু বা প্রিয়জন বা কোন কোম্পানীর কাছ থেকে উপহার পাওয়া নতুন বছর বিশ বিশের ডাইরিতে। লিখেই ফেলিনা তাতে আমাদের জীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ জনের কথা। অকপটে স্বীকার করিইনা আমাদের জীবনে তাঁর অবদানের কথা। কৃতজ্ঞতা স্বীকারে শত্রুতার পরিবর্তে বন্ধুতের জন্ম হয়, মনে আরাম আসে আর তাতে যে কারোরই ভালো লাগার কথা । আত্নকেন্দ্রিকতা দূর হয়ে মনে আধ্যাত্মিকতার আস্বাদ পাওয়া যায়। আর কোন একদিন হয়তো সকল প্রকার মনুষ্যের সবচেয়ে ঈপ্সিত বস্তু — সুখ শান্তিও খুজেঁও পেতে পারি যদি নিজেদের চিন্তা, কথা আর কর্মের মধ্যে সৎ সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। আর বিশ্বাসীরা হয়তো আত্নশুদ্ধি বা আত্নোন্নয়নের মাধ্যমে শেষ বিচারের হাইকোর্ট থেকে দ্রুতযানে পার হয়ে যেতে পারেন টাকা পয়সা ছাড়া পরপারের পুল। তিনি পরম দয়ালু মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ যিনি বিশ্বাসীদের করবেন পার। এই আশায় হয়তো আমরা সবাই আছি।

    দৈনিক অন্তত পনের বিশ মিনিটের জন্য হলেও সারাদিনে সম্পাদিত নিজ কর্মের বিবরন অভিজ্ঞতা অল্প কথায় দিনলিপিতে লিপিবদ্ধ করি। আর সময় পেলে মন খুলে নিজের একান্ত অনুভূতির কথাগুলো ডায়েরির পাতায় কাগজে কলমে গুছিয়ে লিখি, তাতে আর কিছু হোক না হোক নিজেদের দৈহিক মানুষিক সর্বোপরি স্নায়ুবিক স্বাস্থ্যের উন্নতি অবশ্যই হবে । ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় ও সতের সালের মনস্তত্ত্ব বিষয়ক ফ্রন্টিয়ার্স জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উপস্থাপিত ইইজি বা ইলেকট্রো এনসেপালোগ্রামের ছবিতে — কি বোর্ডের পরিবর্তে হাতে কলমে লিখলে মানুষের মস্তিষ্কের অনুভূতি ও স্মৃতিশক্তি নিয়ন্ত্রনকারী সবগুলো কোষের তড়িৎ সক্রিয়তা দেখা গেছে । ডিজিটাল যুগে হাতে লিখার অভ্যাস একদমই হারিয়ে যাচ্ছে। সুন্দর হস্ত লিপি দেখে কেউই এখন আর ওয়াও বলে উঠেনা বা বিস্মিত হয়না।

    যাক সেসব প্যাচআল বা পাঁচালী। নিশ্চয়ই অনেকেই প্রিয়জনকে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাতে ইতিমধ্যেই ডাইরি কলম উপহার দিয়ে দিয়েছেন অথবা নিজেই কারো কাছ থেকে দিনলিপি উপহার হিসেবে পেয়েছেন। অনেকে হয়তো দু একদিনের মধ্যে নিজের জন্য একটা ভালো মানের ডায়েরি সংগ্রহ করবেন। ভালো হয়তো যদি কাল থেকেই লিখা শুরু করতে পারি। এই আশাবাদ ব্যক্ত করে শেষ করছি এবছরের দিনলিপি।

    আর বিশ বিশ সালে সবাইর জন্য রইলো বেশি বেশি শুভেচ্ছা আর শুভকামনা। সকলে শতায়ু হোন। জীবন কাটুক সবাইকে নিয়ে, সুস্থভাবে।

    ফরিদ আহমদ। ১ জানুয়ারি, ২০২০।