পবিত্র ঈদুল আজহা। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হোক সবার জীবন। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদ মোবারক। এবারের ঈদ উপলক্ষে লেখা গল্প “ঠুসি পরে তুশি খুশি”। পড়ার আমন্ত্রণ রইল।
তুশির জন্ম কুমিল্লায়। তাই কুমিল্লার সঙ্গে তার নাড়ির সম্পর্ক । কুমিল্লা তার প্রাণের শহর । ‘কু’ শব্দের শত অর্থ আছে। বাংলাডিক্ট ডট কমে খুঁজে দেখেছে সে। ষোল সালে নিজ জেলার গন্ডি পেরিয়ে তুশি ঢাবিতে আইআর পড়তে আসে। এই প্রথম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের সাথে পরিচিত হবার সবচেয়ে বড় সুযোগ পায় সে।
একদিন তুশির এক বন্ধু তরু তুশিকে বলল, “ডার্লিং, তোকে কিন্তু কুমিল্লার মনে হয় না।” তুশি অবাক হয়ে বলল, “তরু, এতদিন পর হঠাৎ করে তোর এমনটা মনে হলো কেন?” উত্তরে তরু ইতস্তত করে বলল, “না রে, এমনি বললাম আর কী।”
“তুই কী তা হলে এমনি এমনি খাস?” তুশি রহস্যময় হাসি দিয়ে তরুর সাথে খুনসুটি করল। এবারে তরুকে অভয় দিয়ে তুশি বলল, “অসুবিধা নেই ফ্রেন্ড, তুই নির্ভয়ে কারনটা আমাকে বলতে পারিস। আমি রাগ করব না।”
তরু বলল, “না, মানে, কুমিল্লার সব মানুষ খুব খারাপ। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, তোদের শহরে সব মন্দ লোক এক সাথে মিলে থাকে বলে শহরের নাম এমনটা হয়েছে।”
“তুই কী বলতে চাচ্ছিস আমি বুঝতে পারছি না। একটু খোলাসা করে বল।”
“আই মীন, ‘কু’ মানে মন্দ, অসৎ, অসাধু, দুষ্টু ইত্যাদিই তো বুঝায়। আর সব ‘কু’ লোক ‘মিল্লা’ একসাথে বাস করস বলেই তো নাম হয়েছে কুমিল্লা।”
“দেখ তরু, প্রত্যেকটা শব্দের অনেক অন্তর্নিহিত অর্থ থাকে। হ্যাপি বা আনহ্যাপি কনাটেইশন। ফ্রেন্ড, সে মোতাবেক প্রযোজ্য অর্থ নিতে হয়। সব অর্থ সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তুই যেটা বললি সেটা একদমই মনগড়া ব্যাখ্যা। আর এ ক্ষেত্রে যে যার ইচ্ছামত একটা অর্থ দাঁড় করিয়ে সুযোগ নিয়ে থাকে। সত্যি বলছি, আমি জন্মের পর থেকে ঢাকা আসার আগ পর্যন্ত এ রকম কোনো কথা কখনো শুনিনি। হয়তো তুই বলবি, আমি মফস্বলের কূপমন্ডুক। বাহিরের জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞানহীন। আমার কাছে কুয়াই হচ্ছে সাগর।”
“তুশি, ডার্লিং, তুই কিন্তু রেগে যাচ্ছিস। আমি তো তোকে মন্দ বলিনি। তুই হচ্ছিস আমার সবচেয়ে বেস্ট ফ্রেন্ড।”
তুশি রাগ করে একটু উচ্চস্বরে বলল, “দেখ, আমি আমার জন্মস্থানকে খুব ভালোবাসি। প্রত্যেক সমাজেই কিছু মন্দ লোক থাকে। তাই বলে সব লোক খারাপ হয়ে যায় না। এটা কোনো একটা পার্টিকিউলার প্লেইসের দোষ না। মা মাটির দোষ না। তরু, রোমান কবি ভার্জিল কী বলেছে জানিস? তিনি বলেছেন, ‘সেই সবচেয়ে সুখী, যে নিজের দেশকে স্বর্গের মতো ভালোবাসে। তরু, আমি আমার শহরকে আমার দেশকে ভালোবাসি।”
“ডার্লিং, তোর ওপর তো ডি এল রায় এসে ভর করেছে দেখছি।”
“হ্যাঁ, উনি ঠিকই বলেছেন, ‘ধন ধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা, ও সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা, এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।’”
“ঠিক বলেছিস, পরীর মত, রানীর মতো এই দেশ আমাদের আরাধ্য, তুশিমনি।”
“দেখ তরু, প্রায় পাঁচ-ছ’শ পৃষ্ঠার ‘কুমিল্লা জেলার ইতিহাস’ বইটা একসময় আমার সংগ্রহে ছিল। আমি ভালো করে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে দেখেছি বইটা। তুই যেরকম বললি এরকম কিছু তো আমি সেখানে খুঁজে পাইনি।”
“চল, তোকে আজ আমি নিজে ফুসকা বানিয়ে খাওয়াব। আরে ইয়ার , রাগ করিস না। আমরা দুজনে মিলে দু-ইয়ারী কথা বলছি। তুই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমার কথায় তুই রাগ করলে আমার কেমন লাগে, তুইই ভেবে দেখ।
তবে মানছি রাগ করলে তোকে খুব সুন্দর দেখায়, ডার্লিং! বিশেষ করে তোর কপোলের ন্যাচারাল গোলাপী আভাটা। মনে হচ্ছে কবি হাফিজ তোর জন্যই লিখেছিল, ‘প্রিয়ার মোহন চাঁদ কপোলের, একটি কালো তিলের লাগি বিলিয়ে দেব সমরকান্দ ও রত্নখচা এ বোখারা! ডার্লিং! আংকেল আন্টি তোর নাম রৌজ রাখলে ভালো করতেন।”
তুশির মাথায় জিদ চেপে গেল। প্রত্যুতপন্নমতি মেয়ে একটা নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা শুরু করল। এটাও ঐ ইতিহাস বইয়ে সম্ভবত লিপিবদ্ধ নেই। সে বলল, “ দেখ তরু, ‘কু’ শব্দের অর্থ পৃথিবী, মাটি, মৃত্তিকা ইত্যাদিও তো বুঝায়। আমার মনে হয়, পূর্বে কোনো একসময়ে হয়তো এক সাধু পুরুষ এ অঞ্চলে ধর্ম প্রচারের জন্য এসেছিলেন তাঁর গুরুর নির্দেশে। আসার সময়ে তাঁর গুরু তাঁকে একটু মাটি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি এমন একটা জায়গায় গিয়ে তোমার আস্তানা বা আশ্রম প্রতিষ্ঠা করবে যেখানকার মাটি এ মাটির সাথে মিলবে।’ আর তিনি কুমিল্লা শহরে এসে আমাদের মাটির সাথে ঐ মাটির মিল খুঁজে পেয়ে সম্ভবত আনন্দে বলে উঠেছিলেন, “কু’মিল্লা! আসলে ফ্রেন্ড, এসব ব্যাখ্যার সাথে যার যার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সংশ্লেষ থাকে।”
“কুমিল্লা শব্দের বানানটা নিশ্চয়ই সার্বজনীন। এটা যে যার ইচ্ছেমত লিখতে পারে না। যেমন, কুমিল্লার ইংরেজি বানান হচ্ছে Comilla। শৈশব থেকে এই বানানই লিখে আসছি। এখনো ভুল করে লেখছি। দেখ তরু, গত বছরে এ বানানটাও বদল হয়ে গেছে। এখন লিখতে হচ্ছে Cumilla।”
“নামের বানানে কী আসে যায়, তুশি।”
“কিন্তু এ নিয়ে পত্র পত্রিকায় ফেসবুকে কুমিল্লাবাসী ব্যপক লেখা-লেখি আন্দোলন-সংগ্রাম করতে দেখেছি।”
“কোনো লাভ হয়নি, নিশ্চয়ই।”
“ঠিক বলেছিস, তরু।”
“এবারে দেখ তুশি, বর্তমানে গরু না গোরু—কোন বানান ঠিক, এ নিয়ে তুমুল তর্ক চলছে এখন ফেস বুকে । কোরবানি ঈদের আগে হঠাৎ করে এটা বদলের কী দরকার ছিল।”
“হুম, তরু, আমি এ বিষয়ে অনলাইনে একজনের একটা লেখা পড়েছি কিছুদিন আগে। অনেক কিছু জানতে পারলাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি উচ্চারণমূলক বানানের পক্ষপাতী ছিলেন। তাই তিনি গরুকে এক সময় ‘গোরু’ লিখতেন। পরে ‘ই’ বা ‘উ’ থাকলে ‘অ’-এর উচ্চারণ ‘ও’ হয়ে যায়—এটাও নাকি গুরুর আবিষ্কার। এই যুক্তিতে তিনি পরে আবার ‘গরু’ লেখাতেও আপত্তি করেননি। চৌদ্দ’শ পঞ্চাশে নাকি বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এর কোথাও লিখেছেন ‘নান্দের ঘরের গরু রাখোআল।’ বারো’শ সালের ‘চর্যাপদ’এ ‘গরু’শব্দের উল্লেখ আছে নাকি এই ভাবে: ‘উমত সবরো গরুআ রোষ ‘। তবে এই ‘গরু’নাকি গুরু অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।”
তরু অট্ট হাসি দিয়ে বলল, “সেজন্য বুঝি স্কুলে দুষ্টু ছেলে-বেলেরা মজা করে গুরুকে গরু বলত।”
তারপর নাকি মুকুন্দরাম চক্রবর্তী ষোল শ সালে তাঁর পুঁথিতে লিখেছিলেন, ‘ধান্য গোরু কেহ নাঞি কেনে’। আঠার শ পঁচাত্তরে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে গরুকে ‘গোরু’ লিখেছেন। জাতীয় কবিও ‘গোরু’ লিখেছেন।”
“তবে ইয়ার, এতদিন পরে কেন যে এ বিষয় গুলো নজরে এসেছে তা তো আমার বুঝে আসছে না। আসলে আমার মনে হয় বানান দীর্ঘদিনের প্রথার ব্যাপার। দেখ তুশি, কম্পিউটারে বা খাতায় একটা বানান ভুল টাইপ করে বা লিখে তাকিয়ে দেখিস চোখে লাগে। কেমন করেই যেন মনে আসে বানানটা তো সচরাচর এভাবে লেখা হয় না। চোখের সাথে সাথে মনেও ভীষণ খটকা লাগে। তাই হয়তো গরু বানান লেখার চিরাচরিত প্রথাকে আকস্মিকভাবে বদলে দেওয়াতে তাৎক্ষণিকভাবে সেনসেটিভ মানুষগুলো ফেসবুকে সরব হয়েছে। আমি তাতে কোন দোষ দেখছি না, ফ্রেন্ড । যেমনটি ডার্লিং কুমিল্লার ব্যাপারে আমার ব্যাখ্যাটা তোর গায়ে লেগেছে।” তরু হাহা করেহেসে উঠল।
তুশি তরুর বেনি দুটোকে টেনে ধরে বলল, “তোর দুষ্টামি দেখছি আর কমবে না। একটু সিরিয়াস হ ফ্রেন্ড । সামনে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে হবে। বিসিএস প্রিলি দিতে হবে। শুনস না তরু, পেপারে আরো কী লিখেছে?”
“বল, শুনছি আমি।”
“হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে নাকি গরু বানান চার রকমে লেখা আছে। গরু, গোরু, গরূ, গোরূ। এবং লেখক একটা বেশ মজার ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। শুনলে তোর ভীষণ হাসি পাবে। লেজ নামানো গরুর জন্য নাকি র-এর ডানে নিচের দিকে টান দিয়ে দীর্ঘ ঊ-কার হবে। আর লেজ তুলে দৌড় দেওয়া গরুর জন্য র-এর ডানে ওপরের দিকে টান দিয়ে হ্রস্ব উ-কার হবে।”
“হাহাহা। তুশি তুইতো দেখছি বিসিএসের জন্য আজকাল আবোল তাবোল তথ্যও মাথায় স্টোর করে রাখছিস। বরং ডেইট টা মনে রাখ কবে বানানটা বদল করা হয়েছে।”
এবার তরু বল তো, ‘কুরবানি’না ‘কোরবানি’ কোন বানানটা ঠিক?”
তরু বলল, “সেটা জানি না। তবে বাবার চাঁপাইতে একটা গরুর ফার্ম আছে। কোরবানির হাটে নাকি তিনি কিছু গরু তুলবেন, মায়ের কাছে শুনেছি। ঠিকমতো দাম উঠবে তো, আল্লাই জানে? লোকজন করোনার ভয়ে গরু কিনতে বাজারে আসবে তো?”
তুশি বলল, “তুই এক কাজ কর, ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়ে দে।”
“কি যাতা বলছিস, তুশি। বাবা ফেসবুকের ফও বুঝে না।”
“আরে আংকেলের বুঝার দরকার নেই। তুই শুধু আংকেলকে বল কাউকে দিয়ে সব গরুগুলার ছবি তুলে তোর মোবাইলে পাঠিয়ে দিতে। দেখবি লোকজন ফার্মে এসে উনার কাছ থেকে গরু নিয়ে যাবে।”
“এটার সাথে বানানের কী সম্পর্ক, তুশি?”
“দেখ না কী করি।”
তরুর বাবা গরুর ছবি তুলে পাঠালেন। তুশি আর তরু মিলে তাদের ফেসবুক আইডি ব্যবহার করে একটা সাইট খুলল। মিনা এগ্রো নামে। তরুর ছোট বোনের নাম মিনা। মোটাসোটা গরু গুলার নিচে লিখে দিল ‘গোরু’ আর শুকনা গুলার নিচে লিখল ‘গরু’। আর প্রত্যেকটির জন্য ফিক্সড প্রাইস এবং ফার্মের ঠিকানা। হোম ডেলিভারির সুবিধাও আছে। তবু গোরু পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য বেশি চার্জ আর গরুর জন্য কম চার্জ।
লকডাউন, শাটডাউন, রেড জোন ইত্যাদির জন্য তরু তুশি দু’জনে ঢাকায় একটা ফ্ল্যাটে আটকে পড়ে আছে অনেক দিন। তুশিদের কুমিল্লায় করোনায় আক্রান্ত লোকের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। তার দু’একজন আত্নীয়ও ইতিমধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। তবে সকলে বর্তমানে সুস্থ আছেন। অবশ্য,এক নিকট প্রতিবেশি মারা গেছেন। তরু যাচ্ছে না দুরত্বের জন্য। আর তুশিকে সে খুব ভালোবাসে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তাদের হাতে থিসিসের কাজ ছিল। দুজনই অনার্স লাস্ট ইয়ারের ছাত্রী । দুজনের রেজাল্টও ভালো। তাদের প্রায়ই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে যাবে। অনলাইনে ক্লাস শুরু হবে। বাড়িতে গিয়ে নেট কানেকশন ভালো পাওয়া যাবে না। ডাটা স্ট্রিমিং এ সমস্যা হবে। এমনিতে থিসিজের কাজে প্রচুর ব্রাউজ করতে হচ্ছে। ক্যাম্পাসে যেতে পারলে আরো ভালো হত। আবার বিসিএসের জন্য একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল দুজনে। তুশি তরুর বিশ্বাস, মেয়েদের জন্য সরকারি চাকরি সুবিধাজনক। বিসিএসটা হলে আরো ভালো। টিউশনির টাকা দিয়ে এতদিন বাসা ভাড়া দিচ্ছিল। হলে ভালো পড়াশুনার পরিবেশ নেই। দুজনে নিরিবিলি পড়াশুনা করতে পছন্দ করে।
দুই বন্ধু ঠিক করেছে এবার ঈদে বাড়িতে যাবে না। টাকা পয়সার খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। ইদানিং অনলাইনে আগের স্টুডেন্টদের আবার পড়ান শুরু করেছে দুজনে। সামান্য কিছু আউটসোর্সিংয়ের কাজও করছে। আর বাড়ি থেকে বিকাশ করে দুজনের বাবাই মাঝে মধ্যে কিছু করে টাকা পাঠায়। এভাবে সংগ্রাম করে ঠিকে আছে দুজনে এই ঢাকা শহরে।
গরুর কথা বলতে বলতে তুশির মনে তার শৈশবের কথা ভেসে উঠল। সে তরুকে বলতে থাকে, “আমাদের গ্রামের বাড়ির গোয়ালে একসময় অনেক গরু ছিল, তরু! ছেলেবেলায় দেখেছি,..।
তরু তুশিকে থামিয়ে দিয়ে বলে, “তুই ছেলে না। মেয়ে। বল, মেয়েবেলায় দেখেছিস।” “তরু তুই চুপ কর ইয়ার। আমাকে বলতে দে।”
“আচ্ছা বল।”
“দেখেছি, রহমান ভাইকে গরুর মুখে ঠুসি পরাতে, যখন তিনি আমাদের উঠোনে ধান মাড়াই করতেন। যাতে গরু ধান খেতে না পারে। ধান ক্ষেতের আইল থেকে যাবার সময় ঠুসি পরিয়ে নেয়া হতো। বাঁশ, বেত, পাট, এমনকি লতাজাতীয় এক ধরনের গাছ দিয়ে এই ‘ঠুসি’ তৈরি হত।”
“তুশি, আমাদের এখানে এটাকে গুমাই বলে। নাচোলে এর ব্যবহার এখনও আছে। ফসলের মাঠ পেরিয়ে গরু আনা নেয়া করতে নিজের ও অন্যের জমির ফসল রক্ষা করার জন্য দুষ্টু গরুর মুখে গুমাই পরানো হয়।”
“কী মজার ব্যাপার দেখ তরু, ঐ একই জিনিষ ডাক্তার বা রোগীরা পরলে সেটাকে মাস্ক বলে। আর মাস্ক তৈরি হয় সিল্ক, সুতি, পলিয়েস্টার, কৃত্রিম তন্তুসহ নানা রকম কাপড় দিয়ে। শুনেছি, ছয় বছর আগে টরন্টোয় সার্স রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবাই মাস্ক পরত। আর এখন করোনা থেকে বাঁচতে সমগ্র পৃথিবীর সব নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ বনিতা সহ সকল বয়েসি মানুষ রঙ বেরঙের ঠুসি পরছে। অথচ কালের বিবর্তনে গরুর মুখে ঠুসি পরান হারিয়ে গেছে, ফ্রেন্ড।”
“ডার্লিং, “ডু নট গ্রীভ। এনিথিঙ ইউ লুজ কামস রাউনড ইন অ্যনাদার ফোর্ম। সৌ, সারভাইভ দ্বি প্যানডেমিক।” এসময় পাশের ফ্ল্যাটের কেউ একজনের রান্না করা বিরিয়ানির গন্ধ তরু তুশির মুখঠুসির কয়েক পরতের কাপড় ভেদ করে নাকে ঢুকে পড়ছিল। অনেকদিন হয় গরুর গোশত খাওয়া হয়নি দুজনার। দুরন্ত তরুর মনে আসছিল কাজী নজরুল ইসলামের “লিচু চোর” কবিতার কয়েকটি চরণ “…ও বাবা মড়াত করে, পড়েছি সরাত জোরে, পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই, সে ছিল গাছের আড়েই, ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার, ধুমাধুম গোটা দুচ্চার, দিলে খুব কিল ও ঘুষি, একদম জোরসে ঠুসি…।” ছোটবেলায় তরু অন্যের গাছ থেকে বহু লিচু পেড়ে খেয়েছিল।
আর সিরিয়াস মেয়ে তুশি গলা ছেড়ে গাইতে লাগল লালন-গীতিকার চরণ “সাধ্য কি রে আমার সে রূপ চিনিতে, অহর্নিশি মায়া-ঠুসি জ্ঞান-চক্ষেতে…।”
তুশি বলল, “তরু, মজার ব্যাপার দেখ, এখন মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ বিষয়ে পরিপত্রও জারি হয়েছে।”
“তুই ডেইট টা মুখস্থ কর বন্ধু। আমি আর পারছি না।”
“তবে তুশি শুনেছি, গেঞ্জির কাপড়ের মাস্ক অনেক বেশি কার্যকর। গেঞ্জির কাপড়ের মাস্ক নাকি সার্জিক্যাল মাস্কের চেয়েও বেশি কার্যকর।”
“আরো কত কী শুনতে হবে, তরু। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইউনিভার্সিটি আরবানা-শ্যাম্পেইনের এক অধ্যাপক, আমাদের বুয়েটের সাবেক ছাত্র, তিনি নাকি তাঁর দুই পিএইচডি শিক্ষার্থীকে নিয়ে এই গবেষণা করছেন।”
“কেন, দেখলি না নকল মাস্ক সাপ্লাই দেওয়ায় আমাদের ঢাবির এক নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।”
“তিনি আবার গেঞ্জির মাস্কও বানান নাকি, তরু।”
“শুনেছি, তিনি খুব পাওয়ারফুল। এক সময় হলে থাকতে নাকি পলিটিক্স টলিটিক্স করত।”
“গুড পলিটিক্স ইজ গুড। গুড পলিটিশিয়ানরা সব সময় দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করে। যাক বাদ দে এ সব। গতকাল ফেসবুকে দেখলাম, কে জানি সোনার তৈরি মাস্ক পরে ঘুরছে। কেউ কেউ আবার নাকি ডায়মন্ড খচিত মাস্কও বানাচ্ছে বিয়েতে পরার জন্য।”
তুশিরা খুব ধনী নয়। তবে স্বচ্ছল। এবং খুব শিক্ষিত পরিবার। তুশি কখনও কোনো বিষয়ে বাবা মায়ের অবাধ্য হয়নি। করোনা কালে বাবা মার অনুপস্থিতি এবং একাকীত্বের বিষয়টা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়েছে সে। দুই বন্ধুর আলোচনার মাঝখানে তুশির বাবার ফোন এল।
“মা, তুমি কেমন আছ?”
“জি ভালো আছি, আব্বু। আপনারা কেমন আছেন?”
“ভালো। কোরবানির জন্য গরু কিনেছি। তোমার হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠিয়েছি। দেখেছ মা?”
“না আব্বু, এখনো দেখিনি। আচ্ছা দেখিস। খুব সুন্দর । লাল রঙের।”
“ঠিক আছে বাবা, এখন রাখছি। তোমাকে পরে ফোন দিব। একটু তরুর সাথে গল্প করছিলাম।”
“না মা, রাখিস না। আরেকটা কথা বলার ছিল।”
“হ্যাঁ, আব্বু, বল। সংকোচ করছ কেন? আমি তোমার একমাত্র মেয়ে।”
“আমি আর তোমার আম্মা মিলে তোমার জন্য একটা ছেলে পছন্দ করেছি। ছেলেটা ইতালিতে থাকত। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। করোনার আগে বাড়িতে এসেছে। ভেবেছিল এখন চলে যাবে। কিন্তু করোনার কি সব ফেক সার্টিফিকেটের ইস্যুতে আপাতত ইতালিতে কেউ নাকি ঢুকতে পারছে না। এখন সে ভাবছে ইতালিতে আর যাবে না। দেশে একটা কম্পিউটার সফটওয়্যারের ফার্ম দিবে। আর ছেলের বাবা মা এই সুযোগে বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে চাইছেন।”
এক ফাঁকে তুশির মা মোবাইলটা তুশির বাবার হাত থেকে টেনে নিয়ে বলল, “মা, তোর ভাই ভাবিরও ছেলেটাকে খুব পছন্দ হয়েছে। আর ছেলের মা তো তোর ছবি দেখে চোখই সরাতে পারছিল না। বলতে হবে না কার মেয়ে। একেবারে মায়ের মতন রুপে গুনে অনন্যা।”
এবারে তুশির ভাবি বলতে শুরু করেছে, “ ছেলেরা অলরেডি তোমার জন্য সোনার গহনা বানানোর অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। ননদীনি বলতে হয়, তোমার ভাগ্য খুব ভালো। ছেলেটা খুব খরচিয়া। এখন প্রতি ভরি সোনার দাম পঁচাত্তর হাজার টাকা। আরও অবাক হবি তুশি শুনে যে, ছেলে হীরা খচিত একটা মাস্কও তোমার জন্য কোথায় জানি অর্ডার দিয়েছে। ছেলে আমাকে এ কথা তোমাকে বলতে বলেছে। কী তুশি তুমি কোনো কথা বলছ না কেন?”
“হ্যাঁ, তুমি তো আমাকে দৌঁড়াতে পারলেই বাঁচ, ভাবি।”
যেহেতু সবাই উত্তেজনায় একটু বেশি জোরে জোরে কথা বলছিল তরু ওদের অনেক কথা শুনল। হাসতে হাসতে তুশিকে বলল, “কিরে রাজি হয়ে গেলি নাকি?”
“মা বাবার কথার অবাধ্য হইনি কখনো, তরু ফ্রেন্ড। এখন কী যে করি, বুঝে উঠতে পারছি না।? দেখছিস না তাদের কি উচ্ছ্বাস। আনন্দ হচ্ছে। ভাবছি আমার বিসিএস পরীক্ষার কী হবে?”
“চিন্তা করিস না, তুশি। ফেসবুকে পেপারে নিউজ দেখিসনি স্ত্রীর বিশ্বাস ছিল স্বামী এডমিন ক্যাডারে প্রথম হবে। স্বামী-স্ত্রী একসাথে বিসিএস পাশ করেছে। কী সব অদ্ভুত অদ্ভুত ক্যাপশন। তুইও তোর হাজবেন্ডের বিশ্বাস থাকলে ক্যাডার হবি।” এই সব বলে অতি আমুদে তরু হাসছিল।
আর রাশভারী তুশি ভাবছিল, এই অবস্থায় সে কী সিদ্ধান্ত নিবে। মা বাবা ভাই ভাবিকে সে প্রচন্ড ভালোবাসে। তাদের মনে কষ্ট দেওয়ার সাহস বা সংস্কৃতি কোনোটাই তার নেই। তাদের কথা ফেলতে পারবে না সে। তাদের মনে কখনো কষ্ট দিতে পারবে না সে। বিসিএস দিবে? মা বাবার ইচ্ছের কাছে তুশি তার দুনিয়ার শখ কোরবানি দিবে? না ঠুসি পরে খুশি হবে তুশি।
আর তরু বন্ধুর চোখমুখে বিষণ্নতা, উদ্বেগ আর হতাশার ছাপ দেখতে পেয়ে তাকে খুশি করার জন্য মোবাইলটা তুশির হাত থেকে নিয়ে বলল, “দেখি তো তোদের কোরবানির গরুটা দেখতে কেমন?”
“হুম, এটাতো গোরু। তোর বিয়ের ম্যানুর একটা আইটেম জোগাড় হয়ে গেল, ইয়ার।”
ফরিদ আহমদ। ১ আগস্ট,২০২০। ছবি: ডেইলি সান এবং হিন্দুস্থান টাইমস।