ভালো কিছুর কদর করতে বিবেকী মানুষ জানে। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট ভারত ভূখণ্ডে প্রায় ১৯ মাস অবস্থান করেছিলেন। তিনি কোন এক সময়ে বলেছিলেন, “আমি ভারতে অতি উষ্ণ অনেক অঞ্চল দেখেছি। যেখানে সবুজ গাছপালা প্রচন্ড খরতাপে পুড়ে যায়। সেই তীব্র গরমের মধ্যে আমি তথাকার অধিবাসীদের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যায় দু’বেলা খেয়েছি। সারাদিন কোনো প্রকার পানাহার করিনি। এর ফলে আমি নিজের ভেতর অনুভব করেছি এক ধরনের নতুন সজীবতা এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তি।”
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের ভারত ত্যাগের পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নেতৃত্বে তাঁর বিজিত অঞ্চল পাঞ্জাবে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা চন্দ্রগুপ্তের উজির চাণক্য “অর্থশাস্ত্র” নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন,“আমি উপোস থেকে বাচঁতে শিখেছি। উপোস থেকে উড়তে শিখেছি। আমি ক্ষুধার্ত পেটে শত্রুর চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছি।” ফিরোজ রাজ রচিত মহাত্মা গান্ধীর জীবনীতে একথা লেখা রয়েছে যে, “গান্ধীজি রোজা রাখা পছন্দ করতেন। সারাদিন জপতপ করে সন্ধ্যায় বকরির দুধ দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করতেন।”
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র প্রফেসর মোরপান্ড বলেছেন, “আমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি লেখাপড়া করার চেষ্টা করেছি। রোজার বিষয়ে পড়ার সময়ে আমি খুবই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছি। চিন্তা করেছি, ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য এক মহান ফর্মূলা দিয়েছে। ইসলাম যদি তার অনুসারীদের অন্য কোন বিধান না দিয়ে শুধু এ রোজাই দিতো তবু এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কিছু হতে পারতো না।”
প্যারাসাইকোলজির গবেষণায় দেখা যায়, বস্তুবাদী বা ভোগবাদী সভ্যতার কারণে মানুষের মাঝে ধ্বংসাত্বক অপরাধ করার প্রবণতা ক্রমন্বয়ে বেড়ে চলছে। এসব অপরাধের সংঘটন এবং পুনরাবৃত্তি গোটা বিশ্বকে ধ্বংসের অতলে তলিয়ে দিচ্ছে।
বিশিষ্ট মনস্তত্ববিদ সিগমন্ড সিয়াম নিয়ে গবেষণা করে দেখেন যে, মানসিক সমস্যায় জর্জরিত যেসব রোগী আছেন, তাদের ক্ষেত্রে রোজা টনিক হিসেবে কাজ করে। টানা এক মাস সিয়াম সাধনার ফলে অনেক মানসিক রোগী তার মানসিক অবসাদ কাটিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বলেন,“রোজার মাধ্যমে মস্তিষ্কের এবং মনের যাবতীয় রোগ ভালো হয়ে যায়। রোজাদার ব্যক্তির দেহ ক্রমাগত বাহিরের চাপ সহ্য করার যোগ্যতা অর্জন করে।”
‘সাওম’ আরবী শব্দ, এর অর্থ-বিরত থাকা। ‘রোযা’ ফার্সি শব্দ, এর অর্থ- উপবাস থাকা। রোযার ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপরও ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা খোদাভীরু তথা তাক্ওয়াবান হতে পারো।” মহান আল্লাহ তায়ালা হাদিসে কুদসীতে এরশাদ করেন,“রোজা আমার জন্য, আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দিব।”
রোজার বিষয়ে এরকম নির্দেশনাও রয়েছে যে, রোজা রেখে কেউ যেন অশ্লীল কথা-বার্তা ও ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হয়। কেউ রোজাদারের সঙ্গে গায়ে পড়ে গালমন্দ, ঝগড়া, বিবাদ করলেও রোজাদারকে শুধু বলতে হবে,“আমি রোজাদার।”
এই নির্দেশনার সুযোগ নিয়েই শুধুমাত্র হিংসা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে এক দুর্বৃত্ত খুন করে ফেলেছিল এক কঠিন বিশ্বাসীকে। ছুরির আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন তিনি। বারবার শুধু বলছিলেন,“আমি রোজাদার।” শক্তি ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি কোন প্রতিরোধ করেননি । এভাবেই রোজার মর্যাদা সমুন্নত রেখেছিলেন সেই সরল বিশ্বাসী রোজাদার।
বাস্তবে কী ঘটছে? — রোজা থাকা অবস্থায় আমরা প্রায়শ নানারকম মন্দ কাজ করছি। মন্দ কথা, মিথ্যা কথা, বেহুদা কথা, পরনিন্দা, হিংসা, বিদ্বেষ, চুগলি, অন্যের অন্তরে কষ্ট দেওয়া, অন্যের উপর জুলুম করা, ঝগড়া করা, বিবাদ করা, পরের হক ধ্বংস করা, ক্রোধ, লোভ, মোহ তথা রিপুসমূহের বশীভূত হওয়া সহ সকল নিষিদ্ধ কাজ রীতিমত করে চলছি। এসব গর্হিত কাজ থেকে নিজেকে বাচিয়ে রাখছি না। শুধু রমাদান মাসের কথা বললাম। আর বাকি এগারো মাসের কথা নাই–বা বললাম।
মহামারির জন্য সামাজিক বিচ্ছিন্নতার কারনে এবারের রোজা সে অর্থে ভিন্ন রকমের হয়েছে। আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে। চকচকে সামাজিক উত্সবে পরিণত হয়নি। বন্ধু-বান্ধব, আত্নীয়-স্বজনের ইফতার পার্টিতে নিশ্চয়ই কারোর যেতে হয়নি ।
পারিবারের সবার ভালোবাসায় সিক্ত ছিল এবারের রমাদান মাস। কোমলমতি শিশু সন্তানদের স্নেহ-মায়ায় ভরপূর ছিল সিয়াম সাধনা। অবশ্য, মিডিয়ায় মহামারিতে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা এবং মর্মান্তিক সংবাদ শিরোনাম প্রতিনিয়ত নরম মনে ভীষণ পীড়া দিয়েছে। সকলের মধ্যে অতি প্রিয়জনদের সুরক্ষা নিয়ে ভয় ও ভাবনা কাজ করছিল।
অর্থনীতির নিম্নগামীতায় ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে প্রত্যেককে। গরীব, অসহায় ও কর্মহীন মানুষদের কথা ভাবিয়েছে অনেককে। সর্বোপরি, দিন রাত্রিতে রমাদানের নামাজ সহ ধর্মীয় অনুশীলন বেড়েছে বহুগুণে।
বিশিষ্ট আলেমগণ ইসলামের মৌলিক বিধানাবলীকে আকীদা, ইবাদত,মোয়ামালাত, মোয়াশারাত ও আখলাক শিরোনামে ভাগ করেছেন। এই পাঁচটি বিভাগের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা নিম্নরুপ।
প্রথম বিভাগ, আকীদা। আকীদা অর্থ বিশ্বাস। এটি অনেক ব্যাপক বিষয়। ইসলামের একটি মৌলিক বিভাগ। ইসলাম মানুষকে সঠিক ও যথার্থ আকীদা শিক্ষা দান করে। যেমন আল্লাহ এক, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী, কিয়ামত হবে, পুনরুত্থান হবে ইত্যাদি।
দ্বিতীয় বিভাগ, ইবাদত। ইবাদত মানে উপাসনা। ইসলামে ইবাদতের প্রসঙ্গ অনেক বিস্তৃত। আমরা যে নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ্ব করি, যাকাত দেই, কুরবানী করি এগুলো ইসলামের একেকটি ইবাদত।
তৃতীয় বিভাগ, মোয়ামালাত তথা লেনদেন। লেনদেনের ক্ষেত্রে ইসলামের অনেক বিধান আছে। একটি মৌলিক বিধান, বেচাকেনা হালাল, রিবা বা সুদ হারাম।
চতুর্থ বিভাগ, মোয়াশারাত। পারস্পরিক আচরণ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে একের সাথে অন্যের আচরণ কী হবে। এটি ইসলামের অনেক বড় শাখা। অন্যের সাথে ঐ আচরণ করি যা পেলে আমি খুশী হই।
পঞ্চম বিভাগ, আখলাক। স্বভাব-চরিত্র। যেমন এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রিয় সাহাবী হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) কে বলেছেন, “হে আমার বৎস! তোমার পক্ষে যদি সম্ভব হয় তুমি সকাল সন্ধ্যা এমন অবস্থায় অতিবাহিত করবে যে, তোমার অন্তরে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই, তাহলে তাই কর। কারণ এটি আমার সুন্নাহ। আর যে আমার সুন্নাহকে যিন্দা করে সে আমাকে ভালোবাসে। যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।”
আমরা তো সুন্নত বলতে বুঝি নামাজের সুন্নত, রোজার সুন্নত, হজ্বের সুন্নত ইত্যাদি। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, কারো প্রতি বিদ্বেষ না থাকা, সবার প্রতি অন্তর নির্মল থাকা এটিও তাঁর সুন্নত। আখলাক সম্পর্কে কুরআন মাজীদে অনেক আয়াত রয়েছে এবং হাদীসের কিতাবসমূহে অনেক হাদীস রয়েছে।
অতপর ইসলামের শিক্ষাকে প্রধানত দুটি বিষয়ে সন্নিবেশিত করা যায়। একটি হচ্ছে বিশ্বাসের প্রকাশ্য ঘোষণা যাকে ‘ঈমান’ বলা হয়। আর একটি হচ্ছে বিশ্বাসের অন্তর্গত বিষয় যাকে ‘এহসান’ বলা হয়। যা ন্যায়গতভাবে সঠিক সামাজিক নিয়ম-কানুন মেনে চলার মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়। দুটোকে একত্রে অনুশীলন না করলে ইসলাম ধর্ম পালন অসম্পূর্ণই থেকে যায়।
ধর্মীয় বিধিনিষেধ মানা যার যার ব্যক্তিগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটি আল্লাহতা’লা ও বান্দার মধ্যকার বিষয়। কিন্তু সামাজিক বিধি-নিষেধ মেনে চলা একজন বান্দার সাথে অন্য বান্দার মধ্যকার বিষয়। অন্য কথায়, ইসলামিক নীতিমালা যদি আমরা নিজেদের জীবনে ব্যবহারিক প্রয়োগ না করি, পুরো সমাজ, সারা দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে যাবে। এবং আমাদের ভবিষ্যৎ হবে অসম্মানজনক।
ইসলাম ধর্ম তার চমৎকার প্রাণবন্ততার মাধ্যমে সদা পরিবর্তনশীল জীবনযাত্রার সঙ্গে অঙ্গীভূত হওয়ার ক্ষমতা রাখে। প্রত্যেক যুগের, প্রত্যেক সমাজের মানুষের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম। ইসলাম ধর্ম শুধু নামাজ রোজা নয়। এটি একটি জীবন বিধান এবং অন্যের সাথে মোয়ামালাত (অর্থনৈতিক লেনদেন) আর মোয়াশারাত (পারস্পরিক আচরণ) এর বিষয়। আত্মার উন্নতির জন্য মোকামাত (আধ্যাত্মিক নীতি) ইত্যাদি সকল কিছুও ইসলামের অন্তর্ভূক্ত।
মূলত এমন কোন বিষয় পৃথিবীতে দৃষ্ট হবে না যার সমাধান ইসলামে দেয়া হয় নাই। ইসলামের প্রতিটি বিষয় আমাদের পূর্ণাঙ্গরূপে অনুসরণ, অনুকরণ করতে হবে। হুকুম- আহকাম, আদেশ-নিষেধ, স্বদেশ-বিদেশ, ঘর-সংসার, লেনদেন, পারস্পরিক আচরণ, বিচার-আচার, ব্যবসা-বানিজ্য, শাসন ব্যবস্থায় ইসলামের বিধিবিধানের সঠিক প্রতিফলন অবশ্যই ঘটাতে হবে ।
কুরআন মজীদের প্রসিদ্ধ আয়াত, ‘হে ঈমানদারগণ! পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।’ আমাদের জীবনের সকল বলয় যেন ইসলামের ভেতরে চলে আসে। কিছু অংশ ইসলামের ভেতরে আর কিছু অংশ ইসলামের বাইরে থাকলে হবে না।
ইসলাম ধর্মে রাষ্ট্র ও সমাজ চলার যে বিধানাবলী দেয়া হয়েছে তার বেশিরভাগ অনুকরন করে যে দেশগুলি পরিচালিত হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যথাক্রমে নিউজিল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, আয়ারল্যান্ড, আইসল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক ও কানাডা। লেখার শুরুতেই বলেছিলাম, ভালো কিছুর কদর করতে বিবেকী মানুষ জানে।
গ্লোবাল ইকোনমি জার্নালে প্রকাশিত, জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক হুসেন আসকারীর গবেষণায় দেখা গেছে, মালয়েশিয়ার অবস্থান আটত্রিশতম,কুয়েত আটচল্লিশতম, বাহরাইন চৌষট্টিতম। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, মুসলিম দেশগুলো মৌলিক বিধানাবলীর প্রথম এবং দ্বিতীয় বিভাগে অতি সতর্ক। সেখানকার অধিবাসীরা অধিক পরিমানে এ বিষয়গুলোকে চর্চা করে। কিন্তু তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম বিভাগে ভীষণ রকমের উদাসীন। এ বিষয়সমূহে ফেল করে তাদের কোন প্রকার আক্ষেপ অনুশোচনা আছে বলে মনে হয় না।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আসল সর্বহারা আর রিক্ত মানুষ হচ্ছে তারা, যারা কেয়ামতের দিন রোজা, নামাজ, অনেক হজ্জ্ব, দান খয়রাত নিয়ে হাজির হবে। কিন্তু দুর্নীতি করে সম্পদ দখল, অন্যদের হক না দেয়া, মানুষের উপর অত্যাচারের কারণে রিক্ত হস্তে জাহান্নামে যাবে।’
ইসলাম ধর্মের প্রবক্তা আমাদের প্রাণাধিক প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একমাত্র নবী এবং রাসূল, যিনি সেকুলার এবং ধর্মীয় উভয় পর্যায়ে সর্বোচ্চ পরিমাণ সফল। তিনি মহান সৃষ্টিকর্তা, রাব্বুল আলামিন, রাব্বুল ইজ্জাত আল্লাহর প্রিয় হাবীব। পবিত্র ইসলাম শান্তির ধর্ম। এবং এই ধর্মেই আছে, সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। আমাদের নবী করিম (সা.)-ও সে কথা বারবার বলেছেন।
সার্বজনীন ইসলাম ধর্ম প্রত্যেকের প্রাত্যহিক জীবন যাপনে পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করে। নবী করিম (সা.) এর দৈনন্দিন প্রতিটি আচার-আচরণ গুরুত্বপূর্ণ কিংবা সাধারণ যা-ই হোকনা কেন একটি অনুশাসনের সৃষ্টি করেছে যা লক্ষ-কোটি মানুষ বর্তমানকালেও সচেতনতার সাথে মেনে চলছে।
তাঁর দৈনন্দিন প্রতিটি আচার-আচরণ কখনো মানবীয় গুণাবলীর ব্যাপ্তি অতিক্রম করেনি যাতে আমাদের সকলের পক্ষে তা মানা সম্ভব হয়। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের যত মাপকাঠি আছে তা তিনি স্পর্শ করে গেছেন।
আড়ম্বড়পূর্ণ রাজকীয়তার ধারণাকে অস্বীকার করেছেন তিনি। তাঁর জীবনধারণ পদ্ধতি যুক্তি ও ধর্মের সীমার মধ্যে ছিল। দরিদ্র লোকদের প্রতি তাঁর সদয়তা এত বেশী ছিল যে প্রায়ই নবীজির পরিবার পরিজনকে উপবাস করতে হতো। তিনি শুধু দরিদ্র অসহায়দের অভাব মোচন করেই তৃপ্ত হতেন না, তাদের সাথে কথা বার্তা বলতেন এবং তাদের দু:খ দুর্দশার জন্য গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করতেন। তিনি ছিলেন তাদের ঘনিষ্ট বন্ধু এবং বিশ্বস্ত সহযোগী।
তাঁর চরিত্র ছিল নিষ্কলুষ এবং দৃঢ়। তাঁর গৃহ, পোষাক, খাদ্য সবই ছিল অতি সাধারণ। তিনি এতই নিরহংকার ছিলেন যে তাঁর সঙ্গীদের কাছ থেকে বিশেষ কোন সম্মান গ্রহণ করতেন না। কিংবা যে কাজ তিনি নিজে করতে পারতেন তাঁর জন্য অযথা ভৃত্যের সাহায্য নিতেন না। সবসময় সবার জন্য তাঁর দ্বার ছিল উন্মুক্ত। তিনি অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যেতেন। সবার প্রতি তাঁর অপরিসীম সহানুভূতি ছিল। তাঁর বদান্যতা ও মহানুভবতা ছিলো অসীম।
তাঁর সরলতা, মিতাচার এবং অকৃত্রিমতা মানুষের নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শাণিত করতে সক্ষম। সেইসাথে তিনি সবসময় অনুসারীদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন। শেষ বিচারের দিন সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। হাদিস শরিফে বর্ণিত রয়েছে, ‘প্রত্যেক ব্যক্তি হাশরের মাঠে ভয়ে বলতে থাকবে—আমাকে বাঁচান, আমাকে বাঁচান। একমাত্র মুহাম্মদ (সা.) উম্মত নিয়ে চিন্তা করবেন।’
কেয়ামতের বিভীষিকাময় ময়দানে যখন বিচার শুরু হবে তখন সবাই বলতে থাকবে ’ইয়া নাফসি’ ‘ইয়া নাফসি’। তখন কেউ কারো হবে না। এ প্রসঙ্গে কোরআনে এসেছে, ‘সেদিন মানুষ নিজের ভাই, নিজের মা, নিজের পিতা, নিজের স্ত্রী ও সন্তানাদি থেকে পালাবে। তাদের মধ্যে প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর সেদিন এমন সময় এসে পড়বে, সে নিজেকে ছাড়া আর কারো প্রতি লক্ষ করার মতো অবস্থা থাকবে না।’
এক মাস রোজা রাখার পর পালিত হচ্ছে আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি। ঈদ সব সময়ই অন্য রকম অনুভূতির সাথে খুশির জোয়ার নিয়ে আসে।
জন্মের পর থেকে দেখে আসছি, ঈদের দিনটাকে সুন্দর করার জন্য আয়োজন শুরু হয় অনেক আগে থেকেই। ঈদকে উপলক্ষ করে শুরু হয় কেনাকাটা। প্রতিটি বাড়িতেই ঈদের রান্না হয় ব্যাপক আয়োজনে। হরেক রকমের সেমাই সহ মুখরোচক বিভিন্ন খাবার। সকলে একসাথে নামাজ আদায় করে। বন্ধু, পাড়া-প্রতিবেশীরা একে অপরের বাড়িতে আসে। অনেক হৈ-হুল্লোড়, আড্ডা, আনন্দে পালিত হয় ঈদ।
ঈদ উৎসব নিয়ে সব পরিবারের নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে। অনেকের কাছে ঈদ হলো ঘরে ফেরার গল্প। সকলের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করার গল্প। ঈদে ঘরে ফেরা নিয়ে যাত্রা পথে ছোট ছোট অনেক গল্পের সৃষ্টি হয়।
কিন্তু এবারের ঈদের গল্পটা সবার কাছেই ভিন্ন। “নো ঈদ সেলিব্রেশন। নো নিউ ক্লোদস ইন ঈদ। জাস্ট ওয়্যার ইওর বেস্ট ক্লোদস। নতুন জামাকাপড়ের কোনও দরকার নেই। পুরনো ভাল একটা পড়লেই যথেষ্ট। নো শখের জিনিস কেনাকাটা।” — এসব লিখে অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন।
ঈদ তো কেবল আনন্দের উৎসই নয়। এটি মানুষে মানুষে কাছে আসার অনেক বড় এক উপলক্ষ। এতে ঈদ আরও মহিমান্বিত হয়ে ওঠে আমাদের জীবনে। কিন্তু এবারের ঈদ উদযাপন হচ্ছে শুধু নিজের পরিবারের ও বাড়ির বৃত্তের ভিতরে। প্রতিবারের মতো ঈদের কেনাকাটা করা হয়নি কারো। ঈদের ছুটিতে বন্ধুদের সাথে, পরিবারের সাথে ঘুরতে যাওয়াটাও হয়তো এবার হবে না ।
ঘরের ভেতরে ঈদ উদযাপন কী নজিরবিহীন? মনে পড়ে, গত বছরের বৃষ্টিস্নাত ঈদের কথা। প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুন অনেকেই ঘরবন্দী ছিলেন । কিন্তু বর্তমান রোজা ভাঙ্গার দিবসের কথা তথা বিশ্বব্যাপী অন্যরকম এক ঈদ উদযাপনের অভিজ্ঞতার কথা গত ঈদের ঘরবন্দীর দিনলিপিতে নিশ্চয়ই লেখা নেই।
আমরা মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক নজিরবিহীন সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। রাস্তা-ঘাট-জনপদ সব ফাঁকা। বৈশ্বিক মহামারির প্রভাবে আজ অবরুদ্ধ পুরো পৃথিবী। চারদিকে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। মানুষের পৃথিবী শান্ত হয়ে গেছে । অসহ্য এক নীরবতা এসে ভর করেছে। মানুষের হাসি লুকিয়ে গেছে। কোথাও নেই কোন আবেগী আলিঙ্গন।
করোনার কাছে পরাজিত হয়ে রোজ অনেক মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে। শুধু পাখিরাই কিচির মিচির করে প্রকৃতির সজীবতার ঘোষণা করছে। রূপবতী, মেঘবতী ঋতু বর্ষার জলের দিনের জানান দিচ্ছে কদম ফুল।
আলোকিত বিশ্বে করোনার আবির্ভাব সত্যিই যেন এক নির্মম উপহাস। আমাদের পরাজয়ের এক ইতিহাস। দর্প চূর্ণ করার এক প্রতিপক্ষ। ধর্মমতে, এমনিতে কে কোন সময়ে চির বিদায় নিবে তা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। আর এখন সে বিশ্বাস আরো বেড়েছে। প্রাণ সংহারিণী হিসেবে মৃত্যুর জানা শত সহস্র কারণের তালিকায় নতুন এক উছিলার যোগ হয়েছে।
মানুষ আসে এ ধরায় চলে যাওয়ার জন্য। তবুও এ যাওয়া যেন কারোই কাম্য নয়। কেউই মরতে চায়না এ সুন্দর ভূবনে এত অতি নির্জনতায়। ঠাণ্ডা, অন্ধকার, হিম, শীতল পরিবেশে। চরম হতাশায় ডুবে গেছে সকলি। আসলে এখন যা কিছু ঘটছে তা আমাদের কারোর হাতে নেই। সব কিছু এমনিতেই আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
চারিদিকে শুধু হাহাকার। এমন অসুস্থ পৃথিবীতে ঈদ পালন করতে হবে এমনটি আগে কেউ কখনো ভাবতে পারেনি। কল্পনাও করতে পারেনি। আর এই উদ্বেগ, উৎকন্ঠা,এবং আতঙ্কের বাতাবরণেই দেশের কোটি কোটি মানুষ পালন করছেন সম্পূর্ণ এক ভিন্ন ধরনের ব্যতিক্রমী ঈদের। পরিবার, পরিজন, প্রিয়জনদের সুরক্ষার কথা ভেবেই ঈদের অনুভূতিগুলো বাড়িতে থেকেই ভাগ করে নিচ্ছেন সবাই। ঈদ উদযাপন করছেন নিজ নিজ গৃহে। নিজ নিজ পরিবারের সাথে আনন্দের সাথে।
ঈদে গ্রামের বাড়ি, বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের বাসায় যেতে না পারলেও নিশ্চয়ই যোগাযোগ হচ্ছে সকলের সাথে প্রযুক্তির কল্যাণে। ঈদের দিনে সাজগোজ করে বাড়িতেই বসে আছেন হয়তো অনেকে। অতি উৎসাহী কেউ কেউ আবার জুমে দেখে নিচ্ছেন অন্যদের সাজ কেমন হলো। সবার সঙ্গে দেখা করছেন। হাসছেন গল্প করছেন প্রযুক্তির সহায়তায়। ফোন কলে ভিডিও কলে ঈদের আনন্দ যেন শতভাগ পাওয়া যায়, সে চেষ্টার কমতি হয়তো কেউই করছেন না।
প্রতি বছরের মতো এবারের ঈদটা হয়তো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করা হচ্ছে না। একথা সত্যি। তবে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে সেরকমটা মনে হবে না। মহামারির এই সঙ্কট দেশের কোটি কোটি মানুষকে অভাবনীয় বিপর্যয় ও ক্ষতির মুখে দাঁড় করিয়েছে।
কৃষি, পোলট্রি, উৎপাদন, জ্বালানি, নির্মাণ, পরিবহন, আবাসন খাতের চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক, পরিযায়ী শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, দোকানের কর্মচারী, গৃহকর্মে সহায়তাকারী নারী, রাঁধুনি, ফেরিওয়ালা, এবং সংবাদপত্রের হকারসহ করোনায় প্রায় সাড়ে ৬ কোটি শ্রমিক অবর্ণনীয় বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে সহনাগরিকদের সাহায্য করার জন্য এবারের ঈদুল ফিতর এক চমৎকার সুযোগ এনে দিয়েছে।
ফিতরা বা ফেতরা আরবী শব্দ। যা ইসলামে যাকাতুল ফিতর (ফিতরের যাকাত) বা সাদাকাতুল ফিতর (ফিতরের সদকা) নামে পরিচিত। যাকাতুল ফিতর বলা হয় ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গরীব দুঃস্থদের মাঝে রোজাদারদের বিতরণ করা দানকে।
উপরের সংজ্ঞা থেকে ফিতর মানে অন্যের প্রতি সব ধরনের ভাল কাজ করাকেও বুঝতে পারি। আর এবারের ঈদ তো সেটারই ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এখন আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি আমাদের সকলের উচিত সবার পাশে থাকা, অবশ্যই মানসিক দুরত্ব নয় সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে। দানই ধ্যান হোক স্বচ্ছল সকলের। সব বাহুল্য বর্জন করে যদি এই ঈদুল ফিতরের উছিলায় কিছু অসহায় মানুষকে সাহায্য করতে পারি তার চেয়ে বড় আনন্দ আর কিসে আছে।
হে আল্লাহ! আপনি আমাদের সকলের জন্য সুখের দ্বার উন্মুক্ত করুন। বিশ্বাস করি, প্রতিটি অন্তরতম প্রদেশে, পথে, জনপদে, প্রচেষ্টায়, বিপদে, আপদে সাহায্য করতে সদা সর্বদা আপনি আছেন আমাদের সাথে। হে আল্লাহ! আমাদেরকে জ্ঞান ও দয়া দান করুন। আমরা যাতে সঠিক পথে চলতে পারি সে তৌওফিক দিন।
হে আল্লাহ্! নিশ্চয় আপনি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করাটা আপনি পছন্দ করেন। সুতরাং আমাদের সকলকে ক্ষমা করে দিন। সকল প্রশংসা একমাত্র আপনি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য এবং আপনার সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অগণিত দরূদ ও সালাম অতি বিনম্র চিত্তে পেশ করছি। অপনি ছাড়া আমাদের কে আর আছে। আমাদের প্রার্থনাসমূহ কবুল করুন।
আমরা সবাই সুস্থ থাকি। নিরাপদ থাকি। নিশ্চয়ই, আল্লাহ্ তাঁর অসীম করুনাধারায় আমাদের সবাইকে মাফ করে পৃথিবীটাকে সুস্থ করে দিবেন। এই বিশ্বাসে শেষ করছি।
সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা।
ঈদ মোবারক।
ফরিদ আহমদ। ২৫ মে, ২০২০